ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মশার ওষুধ প্রয়োগে গুরুত্ব না দিয়ে দুই সিটি করপোরেশন নাগরিকদের জরিমানা করায় গুরুত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত তিন মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। নাগরিকদের দাবি, বিশেষ অভিযানে যেভাবে জরিমানা করা হচ্ছে, সেভাবে মশার ওষুধ প্রয়োগে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। জরিমানা আদায় ছাড়া আসলে তেমন কোনো কার্যক্রমই নেই বলে দাবি তাদের। অন্যদিকে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, শুধু জরিমানা নয়, যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি সেসব এলাকায় ওষুধ প্রয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে। নির্দিষ্ট এলাকায় বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে অভিজাত এলাকায় ওষুধ প্রয়োগে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের নতুন এলাকাসহ সব এলাকাকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
মশা মারতে চলতি অর্থবছরে ১৬৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাজেট রয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও উত্তর সিটি বরাদ্দ করেছে ১২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। দুই সিটি করপোরেশন প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা এ খাতে বরাদ্দ রাখলেও প্রতি বছরেই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাড়ছে। হাসপাতালে এখন শুধু ডেঙ্গু রোগী। অথচ এ ডেঙ্গুর বাহক এডিস দমনে মূল দায়িত্ব পালন করার কথা সিটি করপোরেশনের। কিন্তু মশক দমন কর্মীদের দেখা না পাওয়ার অভিযোগ সর্বত্র। জরিমানা করে দায় চাপানো হচ্ছে নাগরিকদের ওপর।
দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) গত ১৮ জুন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ হাজার ৪০৪টি বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। এ সময় ৬৯৪ বাসাবাড়ি, স্থাপনা ও নির্মাণাধীন ভবনে মশার লার্ভা পাওয়া যায়। ৬১৮টি বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনা থেকে ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। ডিএসসিসি জানায়, জরিমানা ছাড়াও তারা মতবিনিময় সভা, মশককর্মীদের প্রশিক্ষণ, জনসম্পৃক্তকরণ, মাইকিং, কীটনাশক প্রয়োগ, চিরুনি অভিযান, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীর বাড়িতে বিশেষ অভিযান, লাল চিহ্নিত ওয়ার্ডে বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চিরুনি অভিযান চালিয়েছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গত ৮ জুলাই থেকে এডিস মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ মশক নিধন কর্মসূচি শুরু করে। গত সোমবার পর্যন্ত ৬ লাখ ১২ হাজার ৭২টি সড়ক, ড্রেন ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। নিয়মিত মামলার সংখ্যা ১০২টি। ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা হয়েছে ৩৭৬টি। ৪ হাজার ৭৩টি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এছাড়া তারা জানায়, মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে ৪ লাখ ১৪ হাজার সড়ক, ড্রেন ও স্থাপনায় লার্ভিসাইডিং করা হয়েছে। নোভালুরণ প্রয়োগ করা হয়েছে ৯২ হাজার ৮২১টিতে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড এয়ারপোর্ট আশকোনার কিছু এলাকায় গত এক মাসেও কোনো মশক নিধন কর্মী দেখেননি বলে জানান এলাকাবাসী। তাদের দাবি, ডেঙ্গু শুরু হলে অন্যান্য এলাকায় মশা দমনে ওষুধ প্রয়োগ করলেও আমরা বঞ্চিত থেকে যাই। নতুন ওয়ার্ডগুলো যে সিটি করপোরেশনের অধীনে রয়েছে সেটি মনে হয় তারা ভুলে যান। দক্ষিণখান এলাকার বাসিন্দা মিঠু জানান, এখানে তো বৃষ্টি হলে সড়কের মধ্যেই তিন দিন পানি জমে থাকে। সড়কের পানিতেই তো মশা জন্মে, বাড়িতে বাড়িতে শুধু অভিযান করলে তো হবে না। সড়কের পানি সরানোর কাজও তো করতে হবে।
মিরপুরে প্রতি বছরই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু এ এলাকার বাসিন্দাদেরও অভিযোগ মশক দমনে তারা ওষুধ প্রয়োগ করতে দেখেন না। গুলশান, বনানীসহ অভিজাত এলাকায় যেভাবে মশা দমনে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেভাবে সব এলাকায় গুরুত্ব দেওয়ার দাবি তাদের।
মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকার বাসিন্দা তাহমিদ জানান, যতদিন পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিরা মশক দমনে গুরুত্ব না দেবেন ততদিন পর্যন্ত মশা কমবে না। কাউন্সিলরদের তৎপরতা বাড়ানো অনেক বেশি জরুরি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, যতদিন বৃষ্টি থাকবে ততদিন ডেঙ্গু থাকবে। এ জন্য এলাকাভিত্তিক যেখানে রোগী বেশি সেখানে ওষুধ প্রয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে। যেভাবে কার্যক্রম আসলে চলছে সেভাবে সামনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হবে। সিটি করপোরেশনের তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে।
এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশক নিধনের জোর চেষ্টা চলছে। নিয়মিত ওষুধ ছিটানো ছাড়াও আমরা যেখানেই লার্ভা পাচ্ছি, সেখানেই অভিযান চালাচ্ছি। মানুষকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করা হচ্ছে। স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে কার্টুন বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে পৃথক কমিটি করা হয়েছে। মানুষ সচেতন হলে আমরা ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পাব।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, যদি সিটি করপোরেশনের গাফিলতি থাকত, তাহলে রোগী এত কমে আসত না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় বলা হচ্ছে, ঢাকার রোগী কমছে এবং অন্য এলাকার রোগী বাড়ছে। এখন যে রোগীর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেখাচ্ছে এর বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের রোগী। তারা ঢাকায় চিকিৎসা করাতে এসেছে। ঢাকা দক্ষিণে রোগী অনেক কমে এসেছে। মশক নিধন কার্যক্রম পুরোদমে চলছে।