দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তপসিল এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটের তারিখ ধরে ইসি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আসন্ন ভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলসহ একপক্ষ চাচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী ভোট করতে। অন্যদিকে বিএনপিসহ আরেকটি পক্ষ বিদ্যমান ব্যবস্থায় ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের জানুয়ারির ২৯ তারিখের মধ্যে যেভাবেই হোক না কেন নির্বাচন হতে হবে। কারণ তা না হলে একটি সাংবিধানিক গ্যাপ (শূন্যতা) তৈরি হবে। সেই গ্যাপ তৈরি হলে দেশে একটা অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সেটি তো নির্বাচন কমিশন হতে দিতে পারে না।
মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনের নিজ কার্যালয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর যে দায়িত্ব জাতীয় নির্বাচন করার জন্য, তাতে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। প্রস্তুতি কিন্তু আগে থেকে নিতে হয়। যেমন ভোটার তালিকা করতে হবে, ভোটকেন্দ্র করতে হবে। যারা নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ব্যালট পেপার কেনার জন্য কাগজ প্রকিউরমেন্ট করতে হবে। এখন নির্বাচন ডিসেম্বরে না কি জানুয়ারিতে হবে সেটি পরের বিষয়। নির্বাচন যখনই করেন আপনাকে প্রস্তুতি তো আগে থেকেই রাখতে হবে।
ইসি আলমগীর বলেন, আমরা তো একটি শপথ করেছি, না কি? আমরা কিন্তু সরকারি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী না। আমরা কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়েছি । সেই শপথ তো আমাদের পূরণ করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো কি ভোটের পথে—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংকট আছে। নির্বাচন চায় না এমনটা তো কোনো দল বলছে না। আমাদের নিবন্ধিত যে রাজনৈতিক দল আছে কোনো দলই নির্বাচন চায় না এটি বলেনি। আমরা কেন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেব না।
নির্বাচনে পরিবেশ নিয়ে ইসি আলমগীর বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে হয়তো অনেকে কথা বলছেন। পরিবেশ যাতে সুন্দর করা যায় তার জন্য আমরা চেষ্টা করব। পরিবেশের সবটা সুন্দর করার দায়িত্ব তো আমাদের না। পরিবেশ সুন্দর করা আমাদের যেটুকু দায়িত্ব সেটুকু আমরা করে যাচ্ছি। এদিকে তপসিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো বৈঠকের পরিকল্পনা নেই ইসির। কেননা সেই সময় ইসির হাতে নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, আমরা কাউকে জোর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে পারব না। শুরু থেকেই সকল রাজনৈতিক দলকে আমরা আহ্বান করেছিলাম। আমরা সংলাপে বসেছিলাম। কেউ কেউ আমাদের সংলাপে আসেনি। কেউ কেউ আমাদের এখনো মানেনি। আমরা তাদের বারবার পত্র দিয়ে আহ্বান জানিয়েছি। আমরা আহ্বান সব সময় করে যাচ্ছি। আমাদের দরজা তাদের জন্য সব সময় খোলা। সবার সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি আছি। আমাদের পক্ষ থেকে এ মুহূর্তে ডেকে সংলাপ করার মতো সময় নেই। আমাদের এক দিন (সময়) কমছে, কাজ বাড়ছে।
সাংবিধানিকভাবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। সেক্ষেত্রে ১ নভেম্বর শুরু হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা। নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথা অনুযায়ী, ভোটের তারিখের আগে ৪৫-৬০ দিন সময় রেখে তপসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, প্রত্যাহারের সময় ও প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারের জন্য সময় রাখা হয়। প্রচারণার জন্যে সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ। গত ১১টি সংসদ তপসিল ঘোষণার পর মনোনয়ন জমা থেকে ভোটের তারিখ পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৪২ দিন এবং সর্বোচ্চ ৭৮ দিন সময় রেখে তপসিল ঘোষণার নজির রয়েছে।
ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের তপসিল ঘোষণার জন্য ইসির হাতে সময় আছে মাত্র দেড়মাসের মতো। তপসিল ঘোষণার আগে যাবতীয় প্রস্তুতি প্রায় সেরে ফেলেছে ইসি। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মাধ্যমে তপসিল ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। মাঠ পর্যায়ে প্রিজাইডিং অফিসারদের তালিকা প্রস্তুতির কাজ চলছে। চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ১০৩টি। ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১৪টি। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন কাজও শেষ হয়েছে। পর্যবেক্ষক নিবন্ধন প্রাথমিক ধাপ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষণ নীতিমালাও চূড়ান্ত হয়েছে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চলমান। একই সঙ্গে সংবাদ সংগ্রহে মোটরসাইকেলের অনুমতি দিয়ে সাংবাদিক নীতিমালাও সংশোধন করা হয়েছে। এই মুহূর্তে নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনি সামগ্রী কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে ইসি। ১৫ নভেম্বরের মধ্যে এসব কেনাকাটা শেষ করতে চান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচনি উপকরণও সংগ্রহ শুরু করেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনি কাজের জন্য প্রায় ১১ ধরনের নির্বাচনি সামগ্রীর প্রয়োজন পড়ে। এর মধ্যে ব্যালট পেপার, স্ট্যাম্প প্যাড, লাল গালা, মনোনয়ন ফরম, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাশ সিল, অমোচনীয় কালির কলম, গানি ব্যাগ, হেসিয়ান ব্যাগ (বড়), হেসিয়ান ব্যাগ (ছোট) ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের লক রয়েছে। এরই মধ্যে ব্যালট বাক্স, বাক্সের ঢাকনা, বিভিন্ন ধরনের সিল, কালি ও ব্যাগ কেনার দরপত্র হয়ে গেছে। এবার ব্যালট বাক্স ও ঢাকনা দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকেই কিনছে ইসি, যা আগে বিদেশ থেকে আনা হতো। সেক্ষেত্রে ১ লাখ ৬১ হাজার রিম বা ৩২ লাখ ২০ হাজার দিস্তা কাগজ কেনার প্রক্রিয়াও হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব কাগজ দিয়ে তৈরি হবে ব্যালট পেপার, বিভিন্ন ধরনের খাম ও প্যাড। নির্বাচনের জন্য মোট ৮০ হাজার ব্যালট বাক্স কেনা হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে ৪০ হাজার ও অক্টোবরে ৪০ হাজার ইসির হাতে পৌঁছবে। এগুলো সঙ্গে সঙ্গেই মাঠপর্যায়ে পাঠানো হবে।
ইসি সূত্র জানায়, বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এবার কাগজসহ বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় দ্বিগুণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এদিকে, প্রার্থীদের মনোয়নপত্র দাখিলে বাধাদান ঠেকাতে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে জামানতের টাকাও পরিশোধের সুযোগও থাকবে। অন্যদিকে ভোটকেন্দ্রের নাম ও ভোটার নম্বর খুঁজে পাওয়ার ভোগান্তি কমাতে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করছে কমিশন। এই অ্যাপে ভোটারের তথ্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য রিটানিং অফিসার, সহকারী রিটানিং অফিসার, ডিসি, এসপি, ওসিসহ নির্বাচনের দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের পরিচয়, ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯০ লাখ ৬১ হাজার ১৫৮ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা মিলিয়ে ১০-১২ লাখের মতো জনবল বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন।