সৃজনশীল ব্যক্তি তার মেধা প্রয়োগ করে যা কিছু সৃজন করেন, তাই মেধাসম্পদ। মেধাসম্পদের মালিকানা নিয়ে নিবন্ধন করে কপিরাইট অফিস। কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) ও কপিরাইট বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী সৃজনশীল মেধাস্বত্বের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। একজন প্রযোজক তার মেধাস্বত্ব নিয়ে কপিরাইট অফিসে আবেদন করেন। তাকে সনদ দেওয়ার আগেই তার মেধাস্বত্ব ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে চলে যাচ্ছে। ভুয়া সনদ দিয়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে বাণিজ্যিকভাবে প্রচার হচ্ছে। এমন ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন প্রযোজক ও পরিচালকগণ।
পরিচালক ও প্রযোজকরা অভিযোগ করেছেন, কপিরাইট অফিসের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ নিয়ে একজনের কপিরাইট সনদ আরেক জনকে দিচ্ছে। মেধাস্বত্ব পেতে ডকুমেন্ট জমা দিলেই কপিরাইট অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা ভুয়া সনদ দিয়ে আরেক জনের কাছে বিক্রি করে দেয়। ছবির প্রযোজক একজন, কিন্তু তার ছবি ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে দিয়ে আয় করছেন আরেক জন। অথচ ঐ সিনেমা, নাটক, গান, ভিডিও ডকুমেন্ট বা অন্য কোনো ভিডিও কনটেন্টের প্রযোজক বা পরিচালক বিষয়টি জানেনই না।
সম্প্রতি কপিরাইট অফিসের সহকারী প্রোগ্রামার আবদুল গাফফার ও স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর এ এন এম শাহজাহনের নামে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে এমন অভিযোগ করেছেন কয়েক জন প্রযোজক। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মন্ত্রণালয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্য, জাল সনদ বাণিজ্য, অফিসে আসা সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগগুলো তদন্ত করা হচ্ছে।
অভিযোগ আছে, ২০২১ সালে কম্পিউটারের দশটি মাউসের দাম ধরা হয় ৬০ হাজার টাকা। গ্রিনফিল্ড করপোরেশনের নামে একটি কাগজে কলমে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে কপিরাইট অফিসের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা করেন স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর এ এন এম শাহজাহান ভুঁইয়া। অভিযোগ আছে, ভুয়া বিল দেখিয়ে তিনি এখান থেকে টাকা আত্মসাৎ করেন। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি কপিরাইট অফিসের তৎকালীন রেজিস্ট্রার জাফর রেজা চৌধুরীর নজরে এলে তিনি বিষয়টি লিখিতভাবে সমাধানে আব্দুল গাফফার ও শাহজাহান ভুঁইয়াকে চিঠি দেন। পরে জাফর রেজা বদলি হলে বিষয়টি ওভাবেই পড়ে থাকে।
শাহজাহান ভুঁইয়ার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে কিনেছেন কোটি টাকার ফ্ল্যাট। রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের সঞ্চয়পত্র। একইভাবে আরেক কর্মকর্তা আব্দুল গাফফার আমিনবাজারে জমি কিনে তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগও পড়েছে।
চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির নেতা খোরশেদ আলম খসরু বলেন, কপিরাইট অফিসের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ নিয়ে একজনের কপিরাইট সনদ আরেক জনকে দিচ্ছে। শত শত ছবি ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে (ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) দিয়ে তারা টাকা উপার্জন করছে। অথচ সিনেমার যারা মূল প্রযোজক ও পরিচালক তারা বিষয়টি জানেনই না। সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র—বিক্ষোভ, এই মন তোমাকে দিলাম, ঝড়, কাজী হায়াতের ইতিহাসসহ শত শত ছবির ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। বছরের পর বছর তারা অসাধু চক্র ভুয়া সনদ দিয়ে সিনেমাগুলো ইউটিউবে ছাড়ছে এবং লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছে। এতে প্রযোজক বা নির্মাতারা কিছুই পাচ্ছেন না।
অভিযোগের বিষয়ে সহকারী প্রোগ্রামার আবদুল গাফফার বলেন, যে বিষয় নিয়ে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো নিয়ে কপিরাইট অফিসের সিনিয়র অফিসাররা তদন্ত করছেন। এখন এ বিষয় নিয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
আরেক কর্মকর্তা স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর এ এন এম শাহজাহান ভুঁইয়া বলেন, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। এসব অভিযোগ একটিও ঠিক নয়। অফিসের সহকর্মীদের কেউ কেউ এসব মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত সচিব) মো. দাউদ মিয়া বলেন, বিষয়টি আমি জেনেছি। এটা নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।
উল্লেখ্য, কপিরাইট অফিস সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, সংগীতকর্ম, রেকর্ড কর্ম, শিল্পকর্ম, চলচ্চিত্র বিষয়ককর্ম, বেতার সম্প্রচার, টেলিভিশন সম্প্রচার, কম্পিউটার সফটওয়্যার কর্ম ইত্যাদি নিবন্ধন করে থাকে। মেধাসম্পদের আর্থিক অধিকার হস্তান্তরযোগ্য। কপিরাইট নিবন্ধন করা হলে সৃজনকর্মের নৈতিক ও আর্থিক অধিকার অর্থাৎ মালিকানা সংরক্ষণ সহজ হয়।