রোববার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিশ্ব শিশু দিবস আজ

নিজেদের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে অনেক দূর যেতে চায় ওরা

আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০১:০০

সিরাজগঞ্জের চক শিয়ালকোলের মো. ফরাজ আলী শেখের মেয়ে শাহানা খাতুন। সামনে তার এসএসসি পরীক্ষা। কয়েক দিন আগেই তার বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়। কিন্তু পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর শাহানা কিছুতেই বিয়ে করবে না। বাবা-মাকে সে নানাভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়, বিয়ে হলে তার জীবনে অবনতি হবে।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ব্র্যাকের ‘স্বপ্নসারথি’ দলের সদস্য শাহানার মতো ৫০ জন কিশোরীর সঙ্গে কথা হয়, যারা বাল্যবিবাহ নয়, বরং পড়ালেখা করে কেউ ডাক্তার, কিউ চিকিৎসক, কেউ নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। এদের জন্য প্রয়োজন শুধু সহযোগিতার হাত। এমন স্বপ্নদ্রষ্টাদের জন্য আজ দেশ জুড়ে ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ি’ প্রতিপাদ্য করে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। একই সঙ্গে আজ থেকে শুরু হচ্ছে শিশু অধিকার সপ্তাহ।

দিবসটি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। সেখানে তিনি  বলেন, শিশুদের মনে বড় হওয়ার স্বপ্ন ও সাহস জাগিয়ে দিতে সরকার সব সময় বদ্ধপরিকর। এই লক্ষ্যে শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সুশিক্ষা ও সুস্থ বিনোদন নিশ্চিত করার জন্য আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

‘স্বপ্নসারথি’ দলের আরেক সদস্য শিখা খাতুন, পড়ছে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে। কিছুদিন আগে সে-ও তার বিয়ে ভেঙে দেয়। শিখার বাবা-মাকে পাত্রপক্ষ বোঝাতে সক্ষম হয়, বিয়ের পর তাকে পড়াশোনা করানো হবে। শিখা যা হতে চায়, তা-ই হতে পারবে। কিন্তু শিখাও কম যায় না। নিজের বন্ধুদের একাধিক উদাহরণ টেনে বলে, ওদের কারোরই বিয়ের পরে পড়াশোনা হয়নি, বরং সবাই সংসারের কাজে ব্যস্ত। শেষমেশ শিখার বাবা-মা মেয়েকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে মত দেন। শিখা জানায়, আগে থেকেই তার পড়ালেখার প্রতি ঝোঁক ছিল, তারপর ‘স্বপ্নসারথি’ দলের বৈঠকগুলো তাকে আরও শক্ত করে নিজের অবস্থানে অটল থাকতে শিখিয়েছে।

ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের ৩১টি জেলায় বাল্যবিবাহের হার কমিয়ে আনার জন্য ২০২৩ সালে ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী মেয়েদের নিয়ে গ্রামভিত্তিক ‘স্বপ্নসারথি’দল গঠন করা হয়। বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে এমন কিশোরীদের ‘স্বপ্নসারথি’ দলে অন্তর্ভুক্ত করে জীবনদক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা হয় বলে জানান দলের একজন শিক্ষক মো. মাসুদ রানা। তিনি বলেন, বর্তমানে তারা বাংলাদেশের ৩১টি জেলার ২৪০টি উপজেলায় কাজ করছেন। প্রতিটি উপজেলায় গড়ে ১০টি করে মোট ২ হাজার ৩৪০টি ‘স্বপ্নসারথি’ দল গঠন করা হয়েছে।

এমন আরেকটি ‘স্বপ্নসারথি’ দলের দেখা মেলে সিরাজগঞ্জের জামুয়া গ্রামে। সেখানে মোসাম্মত মরিয়ম খাতুন জানায়, সে ডাক্তার হতে চায়। তারা বাবা মো. মোজ্জাদের হোসেন কৃষিকাজ করেন, মা গৃহিণী। তার অনেক বন্ধু প্রেম করে। তাকেও প্রেম করতে বলে, কিন্তু প্রেম করলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে সে ঐ পথে যায় না। আর একজন অষ্টম শ্রেণির চাঁদনী জানায়, গত এক মাসে তাদের কোনো বন্ধুর বিয়ে হয়নি। আর যাদের বিয়ে হয়েছে, তাদের দেখেছে কী কষ্ট করছে তারা। তাই এখন আর তাদের বন্ধুরা কোনো মতে বিয়ে করবে না। সে নৌবাহিনীর সদস্য হতে চায়। তার বোনের কাছ থেকে শুনে সে এমন স্বপ্ন দেখছে।

ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির প্রধান শাশ্বতী বিপ্লব বলেন, ‘আমরা তিনটা লেয়ারে পলিসি অ্যাডভোকেসি করছি। একটা হচ্ছে একদমই কমিউনিটি লেভেলে। কাজী, ইমাম, এলাকার চেয়ারম্যান—যারা বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে একধরনের রোল প্লে করেন। আরেকটা হচ্ছে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি। ঐ কমিটিগুলোর সঙ্গে আমরা অ্যাডভোকেসি করছি, যাতে তারা বাল্যবিবাহ বন্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। আর জাতীয় পর্যায়ে মিনিস্ট্রি অব উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাফেয়ার্স এবং সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের সঙ্গে, যাতে তারা বাল্যবিবাহসংক্রান্ত আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে ইউএন উইমেন, ইউএন সেক্টরে যারা আছেন, তাদের সঙ্গেও আমরা কাজ করছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, ‘বহু বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে এখনো শহর-গ্রামে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েরা নানা রকম শারীরিক সমস্যায় ভোগে। পাশাপাশি তার একজন পরিপূর্ণ নাগরিক হয়ে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়, স্বপ্ন ভেঙে যায়।’

ইত্তেফাক/এমএএম