বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অযৌক্তিক ঊর্ধ্বমূল্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কষ্টের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অযৌক্তিকভাবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে পণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য হতে পারে। যেমন—পণ্যের উত্পাদন ব্যয় বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, যুদ্ধবিগ্রহ, উত্পাদনের স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হতে পারে। কিন্তু অনেক সময় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই যখন দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয় এবং তা সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হয়, তখন বিষয়টির অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন বলে বোধ করি।
আসলে এর মূল কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অনৈতিকতা এবং অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক মুনাফালাভের আকাঙ্ক্ষা। কিছু কিছু ব্যবসায়ীর নৈতিকতার অবক্ষয় ও সামাজিক দায়বদ্ধহীনতা তাদের মুনাফা বৃদ্ধির এই আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী পরিকল্পিতভাবে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। অথচ ইসলামে এইরূপ মজুতদারি নিষিদ্ধ। জীবিকা নির্বাহের সর্বোত্তম পেশা হিসেবে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে অবশ্যই উত্সাহিত করেছে। আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মদ (স.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন’ (সুরা বাকারা-২৭৫)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, মহান আল্লাহ মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য উত্সাহিত করেছেন। তবে তা আল্লাহর নির্দেশিত হালাল পন্থায় পরিচালিত হতে হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসার শর্ত হলো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টি। নবি করিম (স.) বলেন, আমানতদার ব্যবসায়ীরা হাশরে নবিদের, সত্যবাদীদের ও শহিদদের সঙ্গে থাকবেন (তিরমিজি ১০২৯)। এই হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, ব্যবসা শুধু জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যমই নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশিত পথে আমানতদারির সঙ্গে ও ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টির মাধ্যমে নৈতিকভাবে পরিচালিত হলে সে ব্যবসা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে। কিন্তু মানুষকে কষ্ট দিয়ে, নৈতিকতাবিবর্জিত পন্থায় শুধু নিজের সাময়িক আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবসা পরিচালনা ইবাদত হতে পারে না। অতিমুনাফা বা অনৈতিক গুদামজাত ও সিন্ডিকেট করে উচ্চমূল্যে কোনো দ্রব্য কিনতে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। মহান আল্লাহ ও তার প্রিয় রসুল (স.) এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে আমাদের সাবধান করেছেন।
নবি করিম (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গুদামজাত করল, সে বড় অপরাধ করল’ (মুসলিম শরিফ ১৬০৫)। উল্লেখ্য, দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত হালাল রোজগার। রসুল (স.) বলেন, ‘অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কেয়ামতের দিন অপরাধী হিসেবে উপস্থিত করা হবে। তবে যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সত্কর্ম করে এবং সত্য কথা বলে, তাকে ছাড়া’ (তিরমিজি-১২১৯)। আমরা অনেকেই দৃশ্যত আল্লাহকে ভয় করি, মহানবি (স.)কে ভালোবাসি এবং মহান আল্লাহর পথে ও নবির আদর্শে জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করি। নিয়মিত নামাজ, রোজা, জাকাত আদায় ও হজ পালন করি। কিন্তু নৈতিকতার অনুসরণে এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথে ব্যবসা পরিচালনা করি না। বিশেষত খাদ্যদ্রব্য মজুত করে তা বেশি মুনাফায় বিক্রি করে ব্যক্তিজীবনে লাভবান হওয়ার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হই। ব্যবসায় লাভ একটি যৌক্তিক বিষয়, কিন্তু যখন যৌক্তিকতা ও নৈতিকতাকে ছাড়িয়ে যায়, তাকে বলা হয় জুলুম। মহান আল্লাহ জুলুমকারীদের জন্য রেখেছেন কঠোর শাস্তির বিধান।
মহান আল্লাহ তার সৃষ্টির প্রতি সদয় হতে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তার সৃষ্টির হক আদায় আমাদের নিশ্চিত করতে বলেছেন। নৈতিক পন্থায় ও আল্লাহর প্রদর্শিত পথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে পরকালে যেভাবে কল্যাণের পথে আমরা ধাবিত হতে পারি, ঠিক তেমনি অনৈতিক পন্থায় ব্যবসা পরিচালনা এবং খাদ্যদ্রব্য মজুতদারি, অযৌক্তিক মুনাফা ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমরা যেন পরকালে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি না হই, সে বিষয়ে সবার সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)