বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নোবেল বিজয়ী ইয়ান ফসের সাহিত্যে মৃত্যুচিন্তা

আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:২০

মেয়েটিকে বলে, ‘মরে যাও, স্রেফ মরে যাও। জীবনে বেশি কিছু দেখার নেই, একমাত্র বুড়ো হওয়া ছাড়া’

মা ত্র সাত বছর বয়সে ইয়ান ফসের জীবনে একটি গুরুতর দুর্ঘটনা তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। যদিও বড় হয়ে কমিউনিজম এবং নৈরাজ্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেকে হিপ্পিও দাবি করেছেন। রকস্টারও হতে চেয়েছেন। কিন্তু ঐ মৃত্যুচিন্তাই তাকে তাড়িত করেছে বেশি। হয়তো সেজন্য তাঁর সাহিত্যে মৃত্যুচিন্তা এসেছে বিভিন্নভাবে এবং সেইগুলো বাইবেলের অভিপ্রায় অভিমুখী। সেই মৃত্যুচিন্তার পেছনে কি ছিল একাকিত্ব? তার একটা কবিতার শিরোনাম, ‘ডেথ ভ্যারিয়েশন’। এ কবিতা এরকম:

বয়স্ক নারী নিজের সঙ্গে কথা বলে

যেন সবসময়ই থাকে

এবং সেখানে কখনো না

এবং এটা কখনোই জানা যাবে না

এবং কখনোই হবে না

পরিত্যাগ করা

এটা একটা জীবন

অন্য প্রশান্তি নিয়ে

আমরা যা দেখব তার চেয়ে

আলো অথবা অন্ধকার।

মৃত্যু মহাজাগতিক সময়ের একটা মুহূর্ত। ইয়ান ফসে সেপ্টোলজির এ নিউ নেম উপন্যাসে এভাবে একজায়গায় লেখেন, ‘সে বলে, আজ একটি মহান দিন, যেদিন কিছু ঘটে, হ্যাঁ, একটি ঘটনা, কারণ এটি অদ্ভুত, দিনের পর দিন চলে যায়, সময়টি ধীরে ধীরে যায় যেনবা হঠাত্, হ্যাঁ এটাই শেষ ঘটনা কিন্তু মহান, কেননা দৈনন্দিন জীবনকে তখন দেখে শুধু মহাজাগতিক একটিমাত্র ঘড়ি। বাকি ঘড়ি, যা আমাদের বানানো, সেসব থেমে যায়।’

মৃত্যুকে নিয়ে যে কথাগুলো সেটি স্পষ্ট। আর ঘড়ি বলতে আমাদের হাতঘড়ি ও জৈবিক ঘড়িও যে থেমে যায় তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মৃত্যু মহান কেন? কারণ জীবন কি ইয়েন ফসের কাছে পুনরাবৃত্তির অখ্যান মাত্র?

কারণ, ‘মর্নিং অ্যান্ড ইভিনিং’ উপন্যাসের একটা অংশে দেখি তার বর্ণনা এরকম : ‘সে উঠে দাঁড়ায়। চারপাশ দেখে। তারপর সে মনে করে সবকিছু একইরকম এবং একইসঙ্গে আলাদা। সমস্ত জিনিসই স্বাভাবিক জিনিস কিন্তু সেগুলি একরকম মর্যাদাপূর্ণ, সোনালি এবং ভারীও হয়ে উঠছে, যেন তাদের ওজন নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি এবং মূল্যহীন এবং একইসঙ্গে যেন কোনো ওজনও ছিল না, চারপাশ আছে বা নেই হতে পারে।’

এই যে জীবনকে ভারী ও হালকা হিসেবে চিত্রিত করা—সেটার পেছনেও সেই মৃত্যুচিন্তাই। কীরকম? আমরা তার ‘ড্রিম অফ অটাম’ নাটকটিতে দেখি দুজন লোক নৌকায় বসে আছে। সমুদ্রে। তাদের মধ্যে একজন নিজেকে পানিতে ছুড়ে দিয়ে বলে: ‘আমি খুব ভারী এবং সমুদ্র খুব হালকা।’ এর স্কেল ডাউন ল্যাঙ্গুয়েজ এবং প্রায় অস্তিত্বহীন ক্রিয়া। জীবন এবং মৃত্যুর অবিচ্ছেদ্য দূরত্বের দৃশ্য। আরেক জায়গায় দেখি, অল্পবয়সি একটি মেয়ে একজন লোককে অনুসরণ করে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু ঐ লোকটি আসলে একধরনের এলিয়েন, সে অন্য পৃথিবী থেকে আসে এবং মেয়েটিকে মৃত্যু বেছে নিতে রাজি করায়। লোকটি মেয়েটিকে বলে, ‘মরে যাও, স্রেফ মরে যাও। জীবনে বেশি কিছু দেখার নেই, একমাত্র বুড়ো হওয়া ছাড়া।’

ইয়ান ফসের লেখার বিষয় উদ্বেগ, নিরাপত্তাহীনতা, জীবনের অর্থ ও মৃত্যু। তিনি ‘গ্রান্টা’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটা ইন্টারভিউতে বলছেন, ‘শুনেছি কিছু মানুষ মৃত্যুর আগে বা মরার মূহূর্তে তাদের অতীত জীবন দেখতে পায়। এটা এরকম কি না কেউ জানতে পারে না, তবে সম্ভবত। আমি আমার লেখার ব্যাখ্যা করতে খুব অপ্রীতিকর বোধ করি কিন্তু সেপ্টোলজির পরতে পরতে আছে মৃত্যুই। তবে বিভিন্নরূপে চিত্রিত হয়েছে। যেমন জীবন খুব সুন্দর একটা পেইন্টিং। এটা বোঝার জন্য অন্ধকার দরকার। অন্ধকারে আলো ফেলে যখন জীবনকে দেখবেন তখনই সুন্দর।’

ইয়েন ফসে উপন্যাস ও কবিতার ক্ষেত্রে যেন অস্তিত্ববাদী। আবার নাটকের ক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী। তিনি ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ এবং ও’নিলকে অনুসরণ করেননি। ইয়ান ফসে তাঁর নিজস্ব পথ বেছে নিয়েছেন। হয়তো সেজন্য ইয়েন ফসের নাটককে প্রায়ই আন্ডারড্রামাটিক বলা হয়।

ইয়েন ফসে গ্রান্টার ইন্টারভিউতে বলেছেন, ‘সবই মৃত্যুর ভেতর শেষ হয়। আমার মেলাঙ্কলি উপন্যাসে মৃত্যুকে উপস্থাপন করেছি একটা বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভেতর দিয়ে। তখন আমার দ্বিতীয় স্ত্রী ভারতীয়-নরওয়েজিয়ান গ্রেথে ফাতিমা সৈয়দের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। এবং ভাবছিলাম আমরা আমাদের দৃশ্যাবলির যবনিকা টানছি।’

‘মেলাঙ্কলি’ উপন্যাসের একজায়গা এরকম, ‘তার স্তনের দিকে নজর যেতেই মনে হলো, খুব কোমল ও যথেষ্ট আকর্ষণীয় কিছুও একসময় হয়তো বিশ্রী টিউমারের পাহাড়ের মতো লাগে, যখন সম্পর্কের মৃত্যু ঘটে, যেনবা আমিও তার কাছে কার্টুন।’

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন