বড়দের চড়-থাপ্পড়, কিলঘুসি, লাঠিপেটা থেকে শুরু করে বহুমাতৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার দেশের শিশুরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু নির্যাতন একধরনের সামাজিক ব্যাধি। এর শুরু হয় প্রথমত পরিবার থেকে। পরিবারে একটি শিশু সবচেয়ে বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। আর এই নির্যাতন করে থাকে শিশুর অভিভাবকরা। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের গালমন্দ এবং ‘বুলিংয়ের’ শিকার হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুনির্যাতন নিষিদ্ধ হলেও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা মানছে না। আর যারা শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত বা সুবিধাবঞ্চিত, পথশিশু, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। বর্তমান দুনিয়ার জনপ্রিয় মাধ্যম ডিজিটাল প্ল্যাটফরমেও শিশুরা নির্যাতনে শিকার হচ্ছে। চার দিকের এত সব নির্যাতনের ফলে শিশুর বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে এবং শিশুরা মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
কিছু ঘটনা
আগারগাঁয়ের একটি ঝুপড়ি হোটেলে কাজ করে ১২ বছরের হামীম। দিনচুক্তিতে কাজ করে সে। ঘরে তার নানি ও ছোটভাই আছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই হোটেল মালিকের গালমন্দ ও চড়-থাপ্পড় সহ্য করে কাজ করতে হয় তাকে। নিজের তিন বেলা খাবার আর দিন শেষে ১৫০ টাকা মজুরি। তবে এই মজুরি সে প্রতিদিন তুলে দেয় নানির হাতে। সেই টাকায় হামীমের পরিবারের খাওয়া চলে। মা-বাবা দুই জনই অন্যত্র বিয়ে করে যে যার মতো থাকেন। তারা শামীম ও তার ছোট ভাইয়ের খোঁজ নেয় না। এই শিশু শ্রমিক জানায়, হোটেল মালিক প্র্রতিদিন বলেন, ‘তোরে আর রাখুম না, কাল থাইক্যা আর কামে আইবি না।’ ভালো কাজ করলেও এ কথা বলে, খারাপ কাজ করলেও বলে। হামীম আরো জানায়, এক দিন হাত থেকে পড়ে কাপ ভেঙে ফেলায় হোটেল মালিক তাকে এত জোরে থাপ্পড় দিয়েছিল যে, কান ব্যথায় তার জ্বর এসেছিল। আর দুই-একটা চড়-থাপ্পড় তো রোজই দেয়, আর গালি তো আছেই...। পাঁচ বছরের রোজাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছিলেন তার মা আছমা বেগম। ‘বইয়ের লেখার নিচে আঙুল বসিয়ে পড়তে বললেও শিশুটি বইয়ের লেখার ওপর আঙুল দিয়ে ঢেকে ধরে পড়ছিল।’ এই অপরাধে (!) মা তার হাতে থাকা রুটি বেলুনি দিয়ে সন্তানের আঙুলে মারলে, শিশুটির আঙুল ভেঙে যায়। এরপরও আছমা বেগম মনে করেন যে, শিশুদের পড়তে বসালে দু-চারটা মার না দিলে লেখাপড়া মনে থাকে না। সাত বছরের শিশু আদি। আড়াই মাসের ছোটভাইয়ের সঙ্গে খেলছিল। কিন্তু সেই খেলা মা কোনোভাবেই পছন্দ করছিল না। আর আদি কোনোভাবেই মায়ের কথা শুনছিল না। তখন বাবা এসে আদিকে সরিয়ে দিতে ধাক্কা দিলে খাট থেকে মেঝেতে পড়ে গিয়ে শিশুটির কপাল ফেটে যায়।
হামীম, রোজা ও আদির মতো বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু নানাভাবে ঘরেই নির্যাতনের শিকার। এর মধ্যে তারা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের হাতে। আর এসব নির্যাতন অভিভাবকরা কখনো নির্যাতন হিসেবে দেখেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনোভাবেই শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি করা যাবে না। এতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুদের ভয় দেখানো, হেয় করা বা অপমানজনক কথা বলা যাবে না। তাদের অবহেলা করাও একধরনের নির্যাতনের প্রক্রিয়া। শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দিতে হবে। বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। বাবা-মায়ের মধ্যে অমিল বা ঝগড়া শিশুদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশুর মনোজগতে ব্যাপক প্রলয় তোলে। অথচ বেশির ভাগ মা-বাবা সেই বিষয়টি আমলে নেন না।
জরিপে শিশু নির্যাতনের চিত্র
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মাসিক নির্যাতনের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসেই কেবল ১৩০ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনে শিকার হয়েছে। ২০২২ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি’ শীর্ষক জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। শিশুকে শারীরিকভাবে অত্যাচার করার মধ্যে পড়ে হাত, জুতা, বেল্ট, বোতল দিয়ে মারা, লাথি মারা, টানাহিঁচড়া করা, চুল টানা, দাঁড় করিয়ে রাখা, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেওয়া এবং ঝাঁকি দেওয়া, ছুড়ে ফেলা, চিমটি দেওয়া।
বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৭২ দশমিক ২ শতাংশই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই বলছেন, তাদের মানসিক সমস্যায় ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে।
গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউনিসেফের দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৫ কোটি ৭০ লাখের কাছাকাছি শিশু রয়েছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে ১৪ বছরের নিচে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিশু বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অর্থাত্ প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ৯ জন বা ৯০ শতাংশ শিশু নির্যাতিত এবং প্রতি সপ্তাহে মারা যাচ্ছে ২০ শিশু।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারা দেশে পাশবিক নির্যাতন ও নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ১২ শিশু। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫২৬ জন। নিপীড়নের শিকার ১ হাজার ৪৭৫ শিশু। ২০১৭ সালে শিশুহত্যা ৩৩৯ জন। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ছিল ৪১৮। ২০১৯ সালে ৪৪৮ শিশুকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল ৭৭৬ শিশু। ২০২১ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় ৯০১ শিশু।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২২ এর তথ্য অনুসারে, এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সেগুলো হলো—যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্য দুর্ঘটনা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৬ জন। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৪, অর্থাত্ এক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
অভিজ্ঞজনেরা যা বলছেন
সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ শিশু অধিকার সনদে সই করেছে ১৯৮৯ সালে। কেটে গেছে, দীর্ঘ ৩৩-৩৪ বছর। কিন্তু নিরাপদ হয়নি শিশুর জন্যে এ সমাজ তথা, রাষ্ট্র। আমাদের রাষ্ট্রের ব্যাপক অর্জন নিমেষে মিলিয়ে যায়, যখন শিশু-কিশোরদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ না থাকে। সব অর্জন ফিকে হয়ে যায়, যখন সমাজে নারী-শিশুরা নিরাপত্তাহীন থাকে। নৈতিক অবক্ষয়, বাবা-মায়ের পরকীয়া, সাইবার দুনিয়ার প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তি ও পারিবারিক বিশৃঙ্খল জীবনে শিশুরা বেশি ক্ষতির শিকার।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, বাংলাদেশের শিশুনির্যাতনকে আমরা দুই ভাবে দেখি। একটি হলো পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নির্যাতন। শিশুরা যখন বড়দের কোনো ঘটনার সাক্ষী হয়ে যায়, তখন সেই সাক্ষী না রাখা কিংবা পরিবারের সদস্যদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হন, এটি একটা চিত্র। অন্যটি হচ্ছে, পরিবারের বাইরে শিশু নির্যাতনের অনেকগুলো কারণ আছে। প্রতিশোধের লক্ষ্য হিসেবে শিশুরা নির্যাতন বা হত্যার শিকার হয়। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা বেশি। আমাদের সুরক্ষা কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও, আইন থাকা সত্ত্বেও শিশু নির্যাতন মুক্ত সমাজব্যবস্থা তৈরি করা যাচ্ছে না। কারণ সমাজে আইন এবং কর্মসূচিগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে না। স্বল্প সময়ের মধ্যে আইনপ্রয়োগ করে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করলে বিকৃত মানসিকতার মানুষের জন্য তা উদাহরণ হতো।