হুমায়ূনের জাদুময়তা
শাহ্ কামাল
বাংলা সাহিত্যে ভাব-গাম্ভীর্যে কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। রবি ঠাকুরের রচনায় মায়াময় উপমার শব্দ নির্ঝরে কত চরিত্রের গহিন ব্যাপ্তি আমরা দেখেছি। শরত্চন্দ্র কথার ভাঁজে ভাঁজে চরিত্রকে ছড়িয়েছেন ভাষায়, প্রকৃতির সান্নিধ্যে। বঙ্কিমের চরিত্র নির্মাণ দৃঢ়, গতিময়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের তুলিতে এঁকেছেন ছন্দের চরিত্রময়তাকে। বিভূতিভূষণ নিখাদ বর্ণনায় কত চরিত্রকে জীবন্ত করেছেন। এভাবে বাংলা সাহিত্যে সব কথাশিল্পীর চরিত্র নির্মাণে নিজস্বতা থাকলেও পাঠক ধরে রাখার ক্ষেত্রে হুমায়ূনের চরিত্র নির্মাণ ও বর্ণনার মুগ্ধতা মৌলিক ও অনন্য। আপনি তাঁর একটা উপন্যাসে প্রবেশ করবেন আর নিজেকে আবিষ্কার করবেন। কথায় কথায় নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন উপন্যাসের বিস্তৃত জমিনে। বর্ণনার মানুষটি পাঠকের সঙ্গে হাত ধরে হাঁটে। কথা বলে। কখনো বসে যায় চা পানের আড্ডায়। পাঠকের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যায় প্রতিটি চরিত্রের। কথার মানুষ যখন জীবন্ত মানুষের বন্ধু হয় তখন কথাশিল্পীর দক্ষতা আমরা কোন গুণে বিচার করব? চরিত্র নির্মাণে এ এক অনবদ্য জাদুময়তা।
জীবনের রসায়ন কখনো মৌলিক, কখনো যৌগিক। সমস্যার চাদরে জীবনের রং কত খরায় বিধ্বস্ত হয়। এ সমস্যাসংকুল জীবনকে শব্দ কারিগর অতি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়েছেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে। দর্শন আর যুক্তিকে জীবনের মিথষ্ক্রিয়ায় হুমায়ূন প্রতিটি চরিত্রকে করেছেন অনন্য। হিমু হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রের একটি। মিসির আলীও অপূর্ব। মুনা, রূপা, ছোট মীর্জা, ফরিদ মামা, আজগর, মতি, কুসুম, আনিস, মনা ডাকাত, নান্দাইলের ইউনুস, এলাচি বেগম, দোতরা চাচা, শুভ্র, নীলু ছাড়াও অসংখ্য চরিত্র পাঠককে নাড়া দেয় অবিরত। সমাজের প্রতিটি শ্রেণির চরিত্র উঠে এসেছে হুমায়ূনের গল্প, নাটক, উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে। প্রতিটি চরিত্রে হাস্যরস উপস্থিত। জীবনের অসংগতিতে সহজে যে কোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর যে কৌশল তা কেবল তাঁর রচনাতেই স্পষ্ট। জীবনের জটিল ধাঁধাগুলো উপভোগ করতে করতে প্রতিটি চরিত্র যখন পাঠককে অতিক্রম করে তখন সবার অজান্তেই পাঠক ব্যথিত হয়। চোখের কোণে শিশিরের মতো জমে ওঠে জল। বর্ণনা ও নির্মাণের কারিগর হুমায়ূন আহমেদ পাঠক আর দর্শককে যে জাদুজালে ধরে রাখতে পারেন—তা আর কেউ পারবে কি না সময়ই বলে দেবে।
[নারায়ণগঞ্জ]
দাঁড়কাক ধরেও দেখা হলো না
সিতাপ পাল
আমার অনেক দিনের ইচ্ছা, হুমায়ূন আহমেদের লেখায় অসংগতি খুঁজে বের করব। শ খানেক বই পড়ার পর মনে হলো হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমার এই ইচ্ছা পূরণের কোনো সুযোগ তিনি রেখে যাননি। আজ হঠাত্ হাল ছেড়ে দেওয়া এক নাবিকের জাহাজে একটি দাঁড়কাক এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, ‘সিতাপ ভাই, আজ তোমার ইচ্ছাপূরণের দিন।’
সত্যি-ই কি বলল? নাকি আমার হ্যালোসিনেশন হচ্ছে? হয়তো কাকটা ‘কা-কা’ করছে, আমি শুনছি অন্যকিছু! ৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় এসে আমি বিস্মিত হয়েছি। চলন্ত জাহাজের স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে কাকটার খোঁজে দৌড়ে ছুটে গিয়েছি জাহাজের ছাদে। কাকটা নেই। হুমায়ূন আহমেদও নেই। তিনি বেঁচে থাকলে আজ সমুদ্র ছেড়ে আকাশ কিংবা সড়ক পথ ধরে পাড়ি জমাতাম নুহাশপল্লি অথবা ধানমন্ডির ফ্ল্যাটবাড়িতে। গিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতাম, ‘স্যার, আমি আপনার একজন অতি ক্ষুদ্র পাঠক। ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে যদিও, তবু সত্য এই যে, আমি আপনার ‘দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ উপন্যাসটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অসংগতি খুঁজে পেয়েছি। আপনি উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখলেন ‘আমার নাম লিপি। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। সায়েন্স গ্রুপ।’ অথচ ৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় এসে আহসান সাহেব যখন জিগ্যেস করলেন, লিপি মাইক্রোওয়েব সম্পর্কে জানতে চায় কি না তখন লিপি উত্তর দিল, ‘না, চাই না। আমি আর্টস-এর ছাত্রী, শুধু শুধু সায়েন্সে যাব না। কম জানা যেমন খারাপ, বেশি জানাও খারাপ।’ স্যার আপনি-ই বলুন, এটা কি একটি অসংগতি নয়?’
আমার কথা শুনে হুমায়ূন আহমেদের প্রতিক্রিয়া কেমন হতো? আমি কল্পনা করতে পারছি না। কেউ জানলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন।
হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকাকালীন সময়ে আমি বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের সহকারী মুস্তফা আমাকে প্রতিবার নিরাশ করেছেন। যখনই ফোন দিতাম, তিনি কর্কশ গলায় বলতেন—‘স্যার এখন রেস্টে আছেন।’
আমি আর কিছু বলার আগেই তিনি ফোন রেখে দিতেন। একদিন একটা শক্তপোক্ত ফন্দি আঁটলাম। দুপুরের খাওয়ার পরে ফোন করেছি। যথারীতি মুস্তফা ফোন তুললেন। আমি বললাম, ‘হ্যালো, আমি সিআইডি ঢাকা ব্যুরো থেকে এসপি সিতাপ বলছি। হুমায়ূন আহমেদ আছেন? তাঁর সঙ্গে বিশেষ দরকার।’
মুস্তফা সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘জি স্যার, আছেন। অক্ষণই ডাইক্যা দিতাছি। আপনে একটু অপেক্ষা করেন।’
আমি মনে-মনে অদ্ভুত এক তৃপ্তি অনুভব করলাম। কিন্তু আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। একটু পরে আবারও মুস্তফার পুরনো কর্কশ কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘স্যার রেস্টে আছেন।’
আমি হুড়মুড় করে বললাম, ‘আমি সিআইডি ঢাকা ব্যুরোর এসপি সিতাপ, এই কথা জানিয়েছ?’
তিনি কঠিনভাবে বলল, ‘জি, কইছি।’
‘তিনি কী বললেন?’
‘স্যারে কইছে, উনি সিআইডির কেঁথা পুড়েন।’
তিনি নেই আজ এক যুগ পার হলো।
যেখানেই থাকুন, প্রিয় লেখক, জানবেন আমরা আপনাকে সবসময় ভালোবেসেছিলাম। আজও ভালোবাসি।
[হবিগঞ্জ]
প্রকৃতির সৌন্দর্যসুধার শিক্ষক
মো. বেলায়েত হোসেন
হিম হিম মৃদু কুয়াশায় শীতের আগমনী বার্তা। গাছিরা প্রস্তুত হচ্ছে খেজুরগাছের রস সংগ্রহে। চারদিকে পাকা ধানের মউ মউ সুবাস ও আমেজে প্রজাপতি আর ঘাসফড়িং এক শীষ থেকে অন্য শীষে ঘুরে বেড়ায়। ঘরে ঘরে নতুন ধানের পিঠাপুলির উত্সব। শিউলি-কামিনী-দোলনচাঁপা-বকুলের ঘ্রাণে উতলা চারিধার। ঘাসের উপর শিশিরবিন্দুতে রবির আলোক প্রভা চোখের মনি থেকে মনের মনিকোঠায় ঝলকানি। এ সময়টি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের ভাষায় ‘ঋতুকন্যা’; আর বাংলা ষড়ঋতুর পঞ্জিকায় ‘হেমন্তকাল’। এটি আরো মুখর হয়েছে কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদের আগমনে।
তিনি জীবনের রসায়ন আর মানব মনের রসায়নের মিশ্রণকে দূরদৃষ্টিতে সত্যাকারে তুলে ধরেন, সেই সত্য হয়ে উঠেছে চিরন্তন এক আপ্তবাক্য। কথাসাহিত্যে বাংলাকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তাঁর নির্মাণশৈলী এবং কৃতিত্ব অনবদ্য। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর রয়েছে অভূতপূর্ব ক্যারিশমা।
‘বিরাট খেলার মাঠে একা থাকা যায়, কিন্তু ছোট্ট একটা বাড়িতে একা থাকা যায় না’, ‘মোমবাতির আলোয় বই পড়ার আলাদা একটা আনন্দ আছে। আধো আলো আধো ছায়া। বইয়ের জগিটও তো তাই—অন্ধকার এবং আলোর মিশ্রণ। লেখকের কল্পনা হচ্ছে আলো, পাঠকের বিভ্রান্তি হচ্ছে অন্ধকার।’
এমন শব্দ-বাক্য-ভাষা যখন বিবাগী মনের ভাব; তখন পরিবারের রোষানল থেকে বাঁচতে বাথরুমের ভেন্টিলেটরে বই লুকিয়ে রেখে ভিতরে বসে বুয়েটে পড়া ছেলেটির হুমায়ূননামায় ব্যস্ত থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। তরুণসমাজ বর্তমানে কিশোরগ্যাং, মাদকসহ নানান অপরাধ, অপসংস্কৃতিতে নিমগ্ন, বিপথগামী, বইবিমুখ। হুমায়ূন আহমেদের মতো অন্য কোনো লেখক নতুন প্রজন্মকে লুকিয়ে বই পড়ার চরম আগ্রহ কিংবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে নাটক-সিনেমা দেখার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছেন কি না; তা সময়ের প্রশ্ন।
‘পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে, শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অলৌকিক সংগীত শোনার জন্য আমি থাকব না, এর কোনো মানে হয়?’ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগে বেঁচে থাকা শুধু যে নিজের প্রাণান্ত আকুতি—তা নয়, পাঠকদেরও প্রকৃতিপ্রদত্ত সেই সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন।
[খাগড়াছড়ি]
হুমায়ূনবিরোধী পাঠকের হুমায়ূনবন্দনা
আমজাদ ইউনুস
আমার কাছে সর্বদা কাব্যিক গদ্য ভালো লাগে। কাব্যিক গদ্য আমাকে মুগ্ধ করে। সরজ-সরল লেখা তেমন একটা টানে না। এ বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদের গদ্য আমার একদম অপ্রিয় ও অপছন্দের। তাঁর গদ্য খুব কম পড়তাম। তাঁর গদ্যে সাবলীলতা, প্রাঞ্জলতা ও গতিময়তার প্রতাপ দেখা যায়। তবু তাঁর যে ক’টা বই পড়েছি সবগুলোতেই প্রবলভাবে কোনো এক আকর্ষণ বইয়ের শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়েছে।
হুমায়ূনের লেখায় অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এসব বৈশিষ্ট্য তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা দীর্ঘকাল টিকিয়ে রেখেছে। লেখাকে মাধুর্যযুক্ত করে উপস্থাপনের জন্য লেখকের নানা কায়দা-কৌশল থাকে। হুমায়ূন আহমেদ সাবলীল ভাষায় বর্ণনার কৌশলটি গ্রহণ করেছেন। তবে সাবলীল লেখার কৌশলটি বেশ কঠিন। হুমায়ূন আহমেদ এ কঠিন কাজটি সহজভাবে সম্পন্ন করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার সাবলীলতা অন্যদের থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র। এ সাবলীলতা আটপৌরে মুখের ভাষার মতো। এর ভেতর একটা মুগ্ধতা ও তন্ময়তা আছে। পাঠে স্বতঃস্ফূর্ততা জিইয়ে থাকে। বিরক্তি আসে না। তাঁর শব্দপ্রয়োগে, বাক্যবুননে আর হাস্যরসের স্বাতন্ত্র্য-সুধা ঝরতে দেখা যায় অবিরাম। হুমায়ূন আহমেদ ভাষার সরলতার ভেতর সৌন্দর্যের সোনালি আভা ছড়ানোর সুকৌশল জানতেন। তাঁর লেখায় মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধ ও সাধ্যের দ্বন্দ্বের শিল্পিত রূপায়ন ফুটে উঠেছে। বাঙালি মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনের প্রাত্যহিকতার অনুপম উপস্থাপন তাঁর সৃষ্টিকর্মে দ্যুতি ছড়ায়। জীবনকে সহজ এবং ইতিবাচক করে দেখার বিশিষ্টতা ছিল তাঁর।
বোহেমিয়ান হিমু কিংবা রহস্য উন্মোচনকারী মিসির আলীর অদ্ভুত ও উদ্ভট চরিত্রের ভেতর দিয়ে সত্য ও বাস্তবতা অনুসন্ধানের জন্য তাঁর গতিময় কলমের টানটান বেদনা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ ও সচকিত করে। বাস্তবতার ও পরাস্তবতার সমন্বয় তার লেখাকে অনন্য করে তোলে।
হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপক পড়াশোনা ছিল। যে কারণে তাঁর বৈচিত্র্যময় সৃজনকর্মে সমাজ-প্রতিবেশ ও বহুবর্ণিল জীবনের রূপায়ণ, ভাষা ও পরিবেশ নির্মাণ-কৌশল, চরিত্র-সৃজন ক্ষমতায় তার পাঠের ব্যাপকতা ও পরিধি দৃশ্যমান হয়। তাঁর লেখায় বাস্তব জীবন ও সমাজ প্রসঙ্গের পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনতা মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
[চট্টগ্রাম]