ঋত্বিক কুমার ঘটক অগ্নি আখরে তাঁর নাম অঙ্কিত করে গেছেন। বাঙালির আবেগ আর মেধা, মনন আর প্রতিবাদিতা, ঔজ্জ্বল্য আর হাস্যমুখে অদৃশ্যকে পরিহাস করার নাম ঋত্বিক, যিনি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই নিজ কর্মদোষে (না কর্মগুণে?) আলাদা। গতানুগতিকতার বাইরে, চিন্তাচেতনার অভিনবত্ব আর আত্মবিশ্বাসে সূচিমুখ দৃঢ়তা নিয়ে সম্রাটের মতো জীবনযাপনের নাম ঋত্বিক।
সত্যজিতের সঙ্গে যুগ্মভাবে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম, যে সত্যজিত্ ঋত্বিককে তাঁর চেয়েও অধিক বাঙালি বলে মানতেন। অন্যদিকে সত্যজিত্ সম্পর্কে ঋত্বিকের মূল্যায়ন ছিল শ্রদ্ধা ও নিষ্কপটতার। ভারতবর্ষে সিনেমা মাধ্যমটিকে যদি কেউ সার্বিকভাবে বুঝে থাকেন, তিনি একমাত্র সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিকের এহেন প্রশংসাবাক্য উচ্চারণে সহূদয়তা লাগে, লাগে অপার সততা।
ঋত্বিক তাঁর প্রতিভা নিয়েও নিয়তিতাড়িত। ১৯৫৮ থেকে ’৬১-র মধ্যে চারটি ছবি বানালেন তিনি, যথাক্রমে ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, এবং ‘কোমল গান্ধার’। শেষ ছবিটির প্রযোজকও তিনি। অথচ এর পরবর্তী ছবি ‘সুবর্ণরেখা’ তৈরি করতে চার বছর লাগল প্রযোজক পেতে। ’৬৫-তে মুক্তি পেল সে-ছবি। আবার দীর্ঘদিনের বিরতি। ১৯৭২-এ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, আর ’৭৭ সালে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। তাঁর মৃত্যুর পর রিলিজ করে। এমন ভাগ্যহত শিল্পী কজন আছেন পৃথিবীতে?
অথচ কী ভারতবর্ষে, কী বিদেশে, তাঁর ছবির গুণগ্রাহী বড় কম নয়। জর্জ শাদুল-এর মতো চলচ্চিত্রবেত্তা তাঁকে নিয়ে বই লেখেন, সত্যজিত্-গবেষক মারি সিটন বা এন্ড্রু রবিনসন ঋত্বিককে নিয়ে সোচ্চার ও অনুকূল। কেবল চলচ্চিত্রবোদ্ধারাই নন, কবি-সাহিত্যিকদের কাছেও ঋত্বিক উঠে এসেছেন নবজাত মসিহরূপে।
ঋত্বিকের ছবিগুলির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো বহুমাত্রিকতা। ধরা যাক ‘কোমলগান্ধার’। হিন্দুস্থানি রাগসংগীতের কাফি ঠাটের অন্তর্গত এই বিশেষ মার্গসংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের ই-ফ্ল্যাট ও তত্সহ বাংলার লোকায়ত সংগীতকে আবহে ব্যবহার করে চমত্কৃতি আনা হয়েছে ছবিটিতে। অন্যদিকে ছবির ত্রিমাত্রিকতা ধরা পড়ে নায়িকা অনসূয়ার দোলাচলচিত্ততা, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের বিভাজন আর ভারতবিভাগের বেদনা ও আর্তির মধ্য দিয়ে। আবার ছবির নামে রবীন্দ্রনাথের অনুসৃতি আছে, যেমন দেখি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (শক্তিপদ রাজগুরুর মূল যে উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ এটি, তার নাম ছিল ‘চেনামুখ’) নামটি তিনি নেন শেকসপিয়রের ‘The Tempest’ নাটকের প্রসপেরোর একটি সংলাপ থেকে, ‘Cloud-capped Star’। এতে ঋত্বিক তাঁর সৃষ্টিকর্মে যে কতখানি গভীরসঞ্চারী, তা বোঝা যায়।
ঋত্বিকের আরো বৈশিষ্ট্য, তাঁর ছবির চরিত্রের মধ্য দিয়ে আর্কিটাইপকে ফুটিয়ে তোলা, এবং সেইসঙ্গে সুইস মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং-ব্যাখ্যাত ‘Collective Unconsciousness’-কে মূর্ত করে তোলা। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এ-জিনিস দেখা যায় না। এর ফলে ঋত্বিকের ছবি ধ্রুপদী ঘরানার দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা না করলে তার মূল্যায়ন কখনোই যথার্থ হতে পারবে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে নায়িকা নীতার জন্মদিন দেখানো হচ্ছে জগদ্ধাত্রীপুজোর দিন। এটি আর্কিটাইপের সুন্দর নিদর্শন, কেননা তার গোটা পরিবারটিকে সে একা হাতে ধারণ করে রাখছে। বেকার বড় ভাইকে তার কারুবাসনায় (সংগীতচর্চা) প্রশ্রয় দেয়, হাতখরচের টাকা দিতে কার্পণ্য করে না। বাবা যখন শয্যাশায়ী, পরিবারের বোঝা আরো বাড়ে তার। ছোটভাই চাকরি পেয়ে স্বার্থপরভাবে সংসার থেকে আলাদা হয়ে যায় বলে সংসারে তার আর্থিক অবদান শূন্য। আর যখন সে দুর্ঘটনা ঘটায়, নিজ দায়িত্বে নীতা তার রোগমুক্তির জন্য অর্থব্যয় করে। তার নিজ প্রেমিক বিয়ে করে তার বোনকে। নীতার সহনীয়তা সেই বিয়েকেও মেনে নেয়। পরিপূর্ণ আর্কিটাইপাল চরিত্রের বুনন তাই এই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন ঋত্বিক। আর এর সঙ্গেই তিনি বুনে দেন ইয়ুং-এর ‘Collective Unconsciousness’ তত্ত্ব, যার নিহিতার্থ হলো, ‘সুখের লাগিয়া এ-ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল!’ এই ‘Collective Unconsciousness’-ই আবার ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে এসেছে ‘Terrible Mother’-এর রূপ ধরে। ঋত্বিকের ছবি ধ্রুপদী ঘরানার সঙ্গে লোকায়তের মিলন। একদিকে তাঁর ছবিতে তিনি আনেন উপনিষদের অনুষঙ্গ, আনেন কালিদাসকে, শেকসপিয়র ও অ্যারিস্টটল-এর ‘Complex Tragedy’-কে, আনেন সেতার ও সরোদের মূর্ছনা, অন্যদিকে তাঁর ছবির পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে লোকায়ত ভাষা, বাউল ভাটিয়ালি বিয়ের গান গাজীর গীত, থাকে ছৌ, পট, নৌকাবাইচ, বাঙালিত্ব। ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত অ্যারোড্রামে দুই কচি ভাইবোনকে যখন ‘আজি ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায়’ গাওয়ান, রবীন্দ্রসংগীত ঋত্বিকের ছবিতে বিস্ময়কর মাত্রা নিয়ে আসে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানটি ব্যবহারের কী গভীর দ্যোতনা! অথবা ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’ গানটি যখন ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবিতে নীলকণ্ঠের মর্মমূল থেকে উত্সারিত হয়, দর্শক অভিভূত না হয়ে পারে না। তেমনি ‘কোমলগান্ধার’ ছবিটিতে গভীরভাবে ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গানটির সম্মোহক নিযুক্তি, যা মুক্তি আর আনন্দভৈরবীর স্বাদ এনে দেয়।
জীবিতকালে ঋত্বিক ছিলেন অনাবিষ্কৃত দ্বীপ। যত দিন যাচ্ছে, তাঁর প্রতিভা মূল্যায়িত হচ্ছে তত। দেশে দেশে চলচ্চিত্র-উত্সবে প্রদর্শিত হচ্ছে তাঁর ছবি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জীবিতকালে তাঁর ছবির পূর্বাপর প্রদর্শনী হয় ১৯৬৮-তে। ১৯৭৮-এ মাদ্রাজে, ’৮২, ’৮৩, ’৮৫-তে যথাক্রমে বৃটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকায়। এরপর লিসবন, টোকিও, নেদারল্যান্ডস, লোকার্নো, জুরিখ থেকে ভেনিস, সর্বত্র নন্দিত হচ্ছেন তিনি। মাত্র আটটি চলচ্চিত্র ও কয়েকটি তথ্যচিত্র তাঁকে বিশ্বখ্যাতি দিয়েছে।