কথাসাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা নাট্যাঙ্গনেও হুমায়ূন আহমেদের রয়েছে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা। ‘বহুব্রীহি’, ‘আজ রবিবার’, ‘এইসব দিনরাত্রী’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নক্ষত্রের রাত’ প্রভৃতি নাটক তিনি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। এসব নাটক যেমন হাসির উপাদানে পরিপূর্ণ, তেমনই এতে রয়েছে সমকালীন সমাজ বাস্তবতামূলক শিক্ষা।
হুমায়ূন আহমেদের প্রায় প্রতিটা নাটকে থাকে বোকা বোকা চরিত্র। পাগলাটে কিসিমের পাত্রপাত্রী ও বিশেষ ধরনের অভিনেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তার নাটকের সংলাপগুলো আর দশটা নাটকের চেয়ে আলাদা। যা নাট্যকার হিসেবে তাকে স্বমহিমায় মহিমান্বিত করেছে।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৭৫তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়ার কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম। জন্মদিনে তার জনপ্রিয় পাঁচটি সেরা বাংলা ধারাবাহিক নিয়েই আজকের এই আয়োজন। শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে এসব নাটক নির্মিত হয়েছে।
নক্ষত্রের রাত
পারিবারিক আবহে নাটকটির প্লট নির্মিত। নাটকটি ১৯৯৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বিটিভিতে ধারাবাহিকভাবে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হতে থাকে। ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকে সেই সময়ের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প উঠে এসেছে। পরিবারের সব সদস্যের একসঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া, মা-বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়ের সম্পর্ক, ভালোবাসা, খুনসুটি ও হাসিঠাট্টা ছিল নাটকটির উপজীব্য। নাটকের শুরুতে দেখা যায়, শমী কায়সার আজিজুল হাকিমের মাথায় পানি ঢালছে। আর ওপর থেকে এক ভদ্রলোক ‘মনীষা, মনীষা’ বলে চিৎকার করছে। মনীষা (শমী কায়সার) মাথায় পানি ঢালা শেষ কওে দৌঁড়ে ওপরে গিয়ে দেখে তার বাবা (আবুল হায়াত) চায়ের কাপ সামনে নিয়ে প্রচন্ড রাগে চিৎকার করছে! ঘটনা কি জানার জন্য সে বাবার কাছে গিয়ে দেখে ভদ্রলোকের সামনের টেবিলের ওপর সাতটি মরা পিঁপড়ে! যা তিনি এইমাত্র তার চায়ের কাপ থেকে উদ্ধার করেছেন! এবং তার জন্যই সকাল সকাল এত চেঁচামেচি। মনীষা বোঝানোর চেষ্টা করে চায়ে যে চিনি দেওয়া হয়েছে সেই চিনির কৌটায় পিঁপড়ে ছিল যা সে খেয়াল করেনি! ভদ্রলোক মানতে নারাজ! মনীষাকে চোখের সামনে থেকে দ‚র হতে বলে সে আছাড় দিয়ে কাপ প্লেট দুটোই ভেঙে ফেলে!
এই নাটকে অভিনয় করেছেন অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, দিলারা জামান, আসাদুজ্জামান ন‚র, আব্দুল কাদের, লাকি ইনাম, ড. ইনামুল হক, জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, আজিজুল হাকিম, মেহের আফরোজ শাওন, শীলা আহমেদ, আলী যাকের, সারা যাকেরসহ আরও অনেকে। এতে হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে শীলা আহমেদের অভিনয় দর্শকদের নজর কাড়ে।
আইএমডিবি রেটিং: ৯.৪/১০
বহুব্রীহি
মধ্যবিত্ত পারিবারিক জীবনের আবহে নির্মিত ‘বহুব্রীহি’ নাটক। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৮৮ সালে নাটকটি ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়। এই নাটক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনেই নির্মিত হয়েছে। নাটকটি অত্যন্ত দীর্ঘ। শোনা গেছে, বিটিভিতে রাত সাড়ে আটটায় নাটকটি শুরু হলে রাস্তায় একজন রিকশাচালককেও পাওয়া যেত না। অর্থাৎ শিশু, বৃদ্ধ সব বয়সের, সব শ্রেণির মানুষের কাছে নাটকটির জনপ্রিয়তা ছিল। নাটকটিতে চরিত্র ছিলো সোবহান সাহেবের চরিত্রে অভিনয় করেন আবুল হায়াত, ফরিদ চরিত্রে আলী যাকের, মিলি চরিত্রে লুৎফুন্নেছা, ডাক্তারের চরিত্রে আফজাল হোসেন, আনিসের চরিত্রে আসাদুজ্জামন নূরসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছেন। এই নাটকের দুটি আকর্ষণীয় চরিত্র কাদের ও রহিমার মা।
নাটকের কাহিনীর সারসংক্ষেপ- ডাক্তার সাহেব (আফজাল) মিলির (লুৎফুন্নেছা) প্রেমে পাগল। তাকে ছাড়া কিছু বোঝেন না। আবার বলতেও পারছেন না। স্বভাবে একেবারেই নার্ভাস। মোড়ের একটি ফার্মেসিতে রোগী দেখেন। যখন থেকেই তিনি মিলিকে দেখেছেন, তখন থেকেই তার প্রেমে আসক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যান। সোবহান সাহেবের চিকিৎসা করতে এসেও মিলির সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। সোবহান সাহেব কিছুটা টাশকি খেয়ে যান ডাক্তারের মুখে মিলির নাম শুনে। পরবর্তীতে ডাক্তার নার্ভাস হয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।
মিলিও গোপনে গোপনে ডাক্তারের প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তাইতো পুতুলের সঙ্গে ডাক্তারের বিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার সময় ভীষণ আপসেট হয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, ডাক্তারের সঙ্গে বুঝি তার আর ঘর বাঁধা হলো না। এখানেই সমন্বয়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন আনিস অর্থাৎ আসাদুজ্জামান নূর। ডাক্তার তার কাছে গেলে তিনি পরামর্শ দেন যে আপনি পুতুলের নানাকে বলুন যে আপনি বোকা মেয়ে খুঁজছেন। ব্যাস তাতেই হবে।
যেই বলা, সেই কাজ। ডাক্তার (আফজাল) এসে পুতুলের নানাকে এ কথা বলতেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। বাতিল করে দেন বিয়ের সম্বন্ধ। নাটকে পরবর্তীতে মিস মিলিকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে যান ডাক্তার।
নাটকের আরেকটি ট্যুইস্ট চরিত্র ‘সোবহান সাহেব’। সারাক্ষণ দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করেন আর খাতায় সেসব সমস্যার সমাধান নিয়ে নীলনকশা আঁকেন। বৃদ্ধ বয়সে এছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। কখনও মাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, তো কখনও সত্য দিবসের তত্ত্ব। বিচিত্র সব চিন্তার পোকা তার মাথায় ভিড় করে।
আইএমডিবি রেটিং: ৯.৩/১০
আজ রবিবার
শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প নিয়ে আবর্তিত হয় ‘আজ রবিবার’ নাটকের প্লট। নাটকে বড় চাচা আসগরের চরিত্রে অভিনয় করেন আলী যাকের। তিনি একজন সাইকোলজিস্ট। নিজের ঘরে দাবার বিভিন্ন চাল নিয়ে মগ্ন থাকেন। আর চারপাশের সবার সাইকোথেরাপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। কখনও বাবার মৃত্যুচিন্তা দূর করতে কফিন চিকিৎসা, কখনও আবার হিপ্নোটাইজের মাধ্যমে আনিসকে প্রেমিক বানানো। বিটিভিতে ১৯৯৬ সালে নাটকটি প্রচারিত হয়। ‘বহুব্রীহি’ নাটকের মতো ‘আজ রবিবার’ নাটকটিও হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। নাটকটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো কঙ্কা ও তিতলি দুজনেই আনিসকে পছন্দ করে। কিন্তু সারাদিন পড়ার মধ্যে ডুবে থাকা আনিস কোনোভাবেই সেটা টের পাচ্ছে না।
আইএমডিবি রেটিং: ৯.৩/১০
এইসব দিনরাত্রী
বাঙালি মধ্যবিত্ত নারী জীবনের উপকথা নিয়ে নাটকটি নির্মিত হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত এই নাটক মূলত তার নিজেরই উপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদ এই নাটকে দেখিয়েছেন, নব্বইয়ের দশকে নারীদের, দাঁতে দাঁত চেপে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ, দাম্পত্য কলহ, ভালোবাসা আর সংসারের খুনসুটি। ২১ পর্বের ধারাবাহিকটি ১৯৮৫ সালে বিটিভিতে প্রচারিত হয়। এতে অভিনয় করেন ডলি জহুর, দিলারা জামান, খালেদ খান, বুলবুল আহমেদ, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল খয়ের, রাইসুল ইসলাম আসাদসহ অন্যরা।
আইএমডিবি রেটিং: ৯.৩/১০
কোথাও কেউ নেই
এক সময় ঢাকা শহরের অলিগলিতে বাকের ভাইয়ের নাম শোনা যেত। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের মুখ্য চরিত্র এটি। এই চরিত্রে অভিনয় করেন নাট্যাভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। তার অভিনয় সৌকর্য এতটাই ছিল যে নাটকের কাল্পনিক চরিত্রের ফাঁসির প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ করেন নাটক পাগল দর্শকরা। দেশে অস্থিতিশীলতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় হুমায়ূন আহমেদকে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফোন করে বলেছিলেন যে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কি এড়ানো যায় না?
১৯৯৩ সালে বিটিভিতে প্রচারিত হয় নাটকটি। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নাটকটিতে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মোস্তফা, হুমায়ূন ফরিদীসহ অন্যরা। শহুরে জীবনের বিচিত্রতা এবং মিথ্যা দোষে বাকের ভাইয়ের ফাঁসিই নাটকটির উপজীব্য। নাটকের সারকথা হলো বিচারের আশায় উদ্গ্রীব মানুষের শেষ ভরসা আদালতেও মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে নিরপরাধের প্রাণদণ্ড হয়ে যায়। আর অপরাধীরা ঘুরে দেদারসে ঘুরে বেড়ায়।
নাটকটিতে আসাদুজ্জামান নূরকে বাকের ভাইয়ের চরিত্রে দেখা যায়। সমাজের চোখে উচ্ছৃঙ্খল মাস্তান অথচ প্রকৃতপক্ষে দয়বান সুহৃদ হিসেবেই নাটকে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি।
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৯/১০