শিশুদের সঙ্গে অজান্তেই সমাজ ও পরিবার অদৃশ্য এক প্রকার চাপ প্রয়োগ করে যার ফলে অধিকাংশই মানসিক ব্যাধিতে ভোগে। এমনটা ঘটতে পারে ছেলে ও মেয়ে উভয় শিশুর ক্ষেত্রে। অভিভাবকদের সচেনতার অভাব কিংবা উচ্চ প্রত্যাশা এর জন্য দায়ি। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা যে ধাক্কা নিয়ে বড় হয় তার জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ি। অপরদিকে শিশুদের ওপর অতিরিক্ত প্রত্যাশার বোঝা চাপানো অভিভাবকরা কি ক্ষতিটাই করছেন তা নিজেরাও জানেননা।
পাবনা জেলার চিনাখোড়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে রিয়া। স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়। পারিবারিক দৈন্যদশা এর জন্য অনেকটাই দায়ি ছিল। বিয়েতে মত ছিলনা তার এবং তারা বাবার। কিন্তু নানা আর মায়ের চাপে বাধ্য হয়ে সে বিয়ে করলেও শ্বশুর বাড়ি না যাওয়ার শপথ নেয়। কিন্তু তাকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠানোর জন্য প্রচেষ্টা চলতে থাকে।
ঘটনাটি সে তার স্কুলের প্রধান শিক্ষককে জানানোর পর তিনি তা তৎকালীন স্থানীয় মেয়রের দৃষ্টিগোচর করেন। পরবর্তীতে মেয়র তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। ঘটনার পর রিয়ার পরিবার তাকে প্রায় একঘরে করে রাখার মতো করে অবস্থায় ফেলে এবং তাকে এড়িয়ে চলতে থাকে সবাই। এসব বিষয় তার মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যের আশ্রয়ে থাকা আর বাল্যবিয়ের চাপে সে বিদ্যালয়ে আর মনোযোগী হতে পারেনি। মানুষের বাঁকা কথা তার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এক সময় সে নিজেকে বোঝা ভাবতে শুরু করে আর মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করে।
সমাজে এমন হাজারও রিয়াদের গল্প লুকিয়ে আছে যারা শুধু অন্যের চাপের কারণে নিজের সুন্দর ভবিষ্যত মলিন হতে দেখেছে।
অপরদিকে রাজধানীর মিরপুরের দশম শ্রেণির ছাত্র মুহিন পড়াশোনায় বরাবরই ভালো। কিন্তু তার এই ভালোতে মন ভরেনা মায়ের। মুহিন জানায়, ‘আমি পরীক্ষায় ৮০ শতাংশ নম্বর পেলেও আমার মা আমাকে ৯০ শতাংশ বা ৯৫ শতাংশ নম্বর পাওয়ার জন্য চাপ দেয়। যার ফলে আমি দিন দিন পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি।’ অভিভাবকের এমন অসুস্থ প্রত্যাশায় নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে মুহিনের মতো শিশুরা।
দুটি বাস্তবতাই শিশুর মানসিক ব্যাধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে ডিপ্রেশন বা হতাশা যা শিশুর মানসিক যন্ত্রণা ও অবসাদের অন্যতম কারণ। ডিপ্রেশন ও এর থেকে সৃষ্ট মানসিক যন্ত্রণা কোন ঠুনকো বিষয় নয়। এটি একধরণের মানসিক ব্যাধি, যা ধীরেধীরে সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে কয়েক দশেক আগেও তেমন তোরজোর না থাকলেও বর্তমানে সারা বিশ্বে এটি এখন আলোচনার মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
অনেকে ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদকে স্বাভাবিক ব্যাপার কিংবা ব্যক্তির বাস্তবতাকে মেনে নিতে না পারার অপরিপক্কতা হিসেবে ধরে নেয়, যা একটি ভ্রান্ত ধারণা। প্রকৃতপক্ষে এটি অতিরিক্ত মাত্রায় ও দীর্ঘদিন অবসাদ আর হতাশা থেকে উদ্ভূত মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। এক কথায়, মনের অসুখ বলা যায়।
মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনের কারণ
‘সেরোটনিন’ নামক উপাদানের তারতম্যের কারণে ডিপ্রেশনজনিত সমস্যাটি ঘটে থাকে তবে এক্ষেত্রে ডোপামিন, নরইপিনেফ্রিন, ইত্যাদি উপাদানের হ্রাসের প্রবণতাও একটি কারণ। যা মূলত বায়োলজিক্যাল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া রয়েছে বংশগত কারণ, ইচ্ছার বহির্ভূত কোন সম্পর্কে থাকা বা চাপে পড়ে কিছু করা এবং পরবর্তীতে তার জন্য অনুতপ্ত থাকা, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারা, হীনম্মন্যতা, বুলিংয়ের স্বীকার, সম্পর্কে ব্যর্থতা, যা মূলত কিশোর-কিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এর ভিন্নতা রয়েছে। কারণ শিশুরা বড়দের মতো নিজেকে বুঝতে পারে না ও বেশিরভাগ বাবা-মা এই বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। তারা মন খারাপ বলে বিষয়টিকে উপেক্ষা করেন। আমাদের দেশের পিতা-মাতারা সন্তানের শারীরিক সুস্থতার বিষয়ে যতটা উদ্বিগ্ন তার অর্ধ্বাংশ শিশুর মানসিক সুস্থতা নিয়ে ভাবেন না।
শিশুদের ক্ষেত্রে এই মানসিক অবসাদের কারণ হলো বাবা-মায়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক না থাকা, তাই তালাকপ্রাপ্ত বা পিতা-মাতা কারো অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়া কিংবা পিতা-মাতার অকাল প্রয়াণ হওয়া পরিবারগুলোর শিশুরা মানসিকভাবে বেশ চাপে থাকে ও খুব অসহায় বোধ করে।
তাছাড়া প্রাপ্ত বয়স্কের আগে নেশায় জড়িয়ে যাওয়া, দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থ থাকা, লক্ষ্য অনুযায়ী ফলাফল করতে না পারা, বাবা-মায়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকাতে নিজের সমস্যার কথা বলতে না পারা, স্কুলে বন্ধুদের সাথে মনোমালিন্য, শিক্ষকদের নিকট হতে উৎসাহ না পাওয়া, অতিরিক্ত পড়াশুনার চাপ, শিশুদের মেধা বিকাশের সুযোগ না থাকা এবং সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বিনোদনের অভাবে একঘেয়ে পরিবেশ, খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকা, থায়রয়েড জনিত সমস্যা, হরমোনজনির সমস্যা, ভিটামিন ডি-এর অভাব, মমনোনিউক্লিওসিস প্রভৃতি বিষয়কে শিশুদের ডিপ্রেশনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ডিপ্রেশনের লক্ষণ
শিশুদের ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে যাওয়া, নতুন কারো সঙ্গে পরিচিত হতে না চাওয়া বা নিজেকে আড়াল করতে চাওয়া, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, বাবা-মা থেকে দূরে গেকে ভয় পাওয়া, স্বাভাবিক পপড়াশুনার, খেলাধুলায় অনীহা, সবসময় আতঙ্কে থাকা, রাগে নিজেকে আঘাত করা, খিটখিটে মেজাজ, সবকিছুতে বিরক্তবোধ থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আগ্রহ দেখালে, অতিরিক্ত জেদ দেখানো, ওজন হ্রাস,খাবারের প্রতি রুচি কমে যাওয়া বা বৃদ্বি পাওয়া, অন্যমনস্ক থাকা, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে থাকতে চাওয়া, ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা, স্কুলে যেতে না চাওয়া, মাথা ব্যথা বা পেট ব্যথা, যা দীর্ঘদিন ধরে সাড়ছে না, বিনোদনমূলক কাজের প্রতি অনীহা, মৃত্যুর প্রতি ঝোঁক থাকা, সমলোচনা বা প্রত্যাখ্যান সহযে মেনে নিতে না পারা বা সংবেদনশীলতা দেখানো, মানসিক ফোবিয়া, নানা চাহিদা ও আবদার করতে থাকা উল্লেখযোগ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি শিশু যদি দুই সপ্তাহের বেশি গম্ভীর থাকে বা অবসাদে ভুগতে থাকে, তবে তা ডিপ্রেশন ডিসঅর্ডার হিসেবে ধরা হয়।
ডিপ্রেশনের প্রভাব
শিশুরা এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পন্থা হিসেবে বিপথগামী হওয়াসহ, আত্মহত্যার পথে পা বাড়াচ্ছে। সম্প্রতি ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অন্তত ১৩ শতাংশ ভুগছে মানসিক সঙ্কটে। যার মধ্যে, ১০-১৯ বছর বয়সি প্রতি ৭ জনের মধ্যে ১ জনেরও বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
প্রতি বছর প্রায় ৪৬ হাজার কিশোর-কিশোরী এই অবসাদের কারণে আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ২৯৮টি শিশু আত্মহত্যা করেছে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২১৩। যা আমাদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।
ডিপ্রেশন নিরসনে করণীয়
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে বাবা-মাকে তৎপর হতে হবে। শিশু ভাষা, চাহিদা ওঅনভূতির মূল্যায়ন করার পাশাপাশি সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, মুক্তমনা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ দেওয়া, কারও সঙ্গে তুলনা করে অসুস্থ প্রতিযোগীতায় না নামানো, পড়াশোনায় বাড়তি চাপ না দেওয়ার মতো বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। কোনো শিশুকে অবসাদে ভুগতে দেখলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে অবহেলা করা উচিত নয়।
একবিংশ শতাব্দীতেও এই মানসিক অবসাদের বিষয়টিকে ন্যাকামি বা অতিরিক্ত আহ্লাদ বলে উপেক্ষা করে দেশ গড়ার কারিগরদের অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হচ্ছে। ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে শত শত সম্ভাবনাময় শিশু।