তাবলিগ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রচার করা, বার্তা পৌঁছে দেওয়া। একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানোর নামই ‘তাবলিগ’। তাবলিগের মুখ্য উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক স্থাপন করা। নবি-রসুলদের মূল দায়িত্ব ছিল এই দিনের দাওয়াত। তারা নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে আত্মভোলা মানুষকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে এনেছেন। নবুওতের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সর্বশেষ এ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে আখেরি নবির উম্মতের ওপর। রসুল (স.) বিদায় হজের ভাষণে লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘হে উপস্থিত লোকসকল! তোমরা অনুপস্থিত লোকদের কাছে আমার দিনের এই বাণী পৌঁছে দেবে।’
রসুল (স.)-এর জীবদ্দশায় ইসলাম যে পূর্ণতা পেয়েছিল, তার ইন্তেকালের পর সুযোগ্য সাহাবায়ে কেরাম দিনের দাওয়াতের মাধ্যমে বিশ্বে তা আরো বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন। সাহাবিদের পর তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন, আয়েম্মায়ে মুজতাহেদিন, উলামায়ে কেরাম ও দিনের দায়ীগণ ইসলামের প্রচার-প্রসারে নানাভাবে কাজ করেছেন। কেউ ইলমে কুরআন ও ইলমে হাদিস শিক্ষাদানের মাধ্যমে, কেউ ফেকাহ ও দিনের মাসালা-মাসায়েল আলোচনার মাধ্যমে, কেউ কিতাব লিখে ইসলামের খেদমত করেছেন, কেউ ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে দিনের প্রচারকাজ চালিয়ে গেছেন, আবার কেউ ইলমে তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে দিনের প্রচার করেছেন। মোট কথা, ইসলাম প্রচারের যত মাধ্যম ছিল ওলামায়ে কেরাম ও মুবাল্লিগগণ তা অবলম্বন করে ইসলামকে প্রবহমান রেখেছেন।
বর্তমানে বহুল প্রচলিত তাবলিগের রূপকার হচ্ছেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)। তিনি ১৯১০ সালে ভারতের মেওয়াত পল্লিতে স্বল্পসংখ্যক লোক নিয়ে এই মেহনত শুরু করেন। তাবলিগ তথা দিন প্রচার সব ইমানদার নর-নারীর কাজ। যে ইমানদার ব্যক্তি নিজে ইসলামের কোনো একটি বাণী জানবেন, তা অন্যের কাছে পৌঁছানো তার দায়িত্ব। এভাবেই যুগে যুগে ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়ে আসছে। আল্লাহ তার প্রিয় হাবিবকে দিনের দাওয়াত পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়ে সুরা মায়িদায় ইরশাদ ফারমান, ‘হে রসুল! আপনার ওপর আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করতে থাকুন। যদি আপনি তা না করেন, তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না।’ (আয়াত ৬৭)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে সুরা নাহলের ১২৫তম আয়াতে তাবলিগের নির্দেশ করে বলেন, ‘হে নবি! আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে মানুষকে আহ্বান করতে থাকুন হিকমত ও প্রজ্ঞা দ্বারা, সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে। আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করবেন উত্তম পন্থায়।’ সুরা আল ইমরানের ১০৪তম আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকে, যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, ভালো কাজের নির্দেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। (এ কাজ যারা করবে) তারাই সফলকাম।’ মহান আল্লাহ এই সুরার ১১০তম আয়াতে আরো বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির কল্যাণে তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তোমরা ন্যায়ের আদেশ করবে, অন্যায় থেকে বিরত থাকতে বলবে আর আল্লাহতে বিশ্বাস করবে।’
মহান আল্লাহ হা-মিম সাজদাহর ৩৩তম আয়াতে ইরশাদ ফারমান, ‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করে, নেক কাজ করে এবং বলে, আমি তো মুসলিমদের একজন।’ ব্যাপক অর্থে দিনের দাওয়াত বলতে বোঝায়, দিনের পথে মানুষকে আহ্বান করা, পথভোলা মানুষকে পথের সন্ধান দেওয়া, বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে আনা, সুপরামর্শ দেওয়া, চরিত্রবান ও সত্সাহসী করে গড়ে তোলা, বিপদগ্রস্ত ও অসহায়দের সাহায্য করা, ভালো কাজে উত্সাহিত করা, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা, মানুষকে কর্মচঞ্চল করে তোলা, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা—এক কথায়, ইহকাল ও পরকালের শান্তির জন্য মানুষকে সত্য ও সরল পথে চলার আহ্বানই হচ্ছে দাওয়াত ও তাবলিগ। পৃথিবীতে সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এই দিনের দাওয়াতের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তাআলা এই দাওয়াতি কাজ প্রত্যেক বান্দার জন্য ফরজ করেছেন। বান্দা কখনো ব্যক্তিগতভাবে দিনের প্রচার করবে আবার কখনো সমষ্টিগতভাবে দিনের প্রচার করবে। সময়ের চাহিদা ও নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী দিনের দাওয়াত দেওয়া সবার ওপর ওয়াজিব।
লেখক : শিক্ষক, জামেয়া কুরআনিয়া, আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসা, ঢাকা