দেশে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। এর মূল কারণ মাদকের গডফাদাররা দীর্ঘদিন ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন। ফলে ইয়াবা, আইস, এলএসডি, ডিএমটি, খাত, কোকেন, এনপিএস নামের এসব ভয়ংকর মাদক দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। মাদকবিরোধী অভিযানে ধরা পড়েন শুধু খুচরা বিক্রেতারা। গত এক বছরে দেশে মাদকের মামলা হয়েছে ৯৭ হাজার ২৪১টি। আসামি ১ লাখ ২০ হাজার ২৮৭ জন। তবে যে পরিমাণ মাদক দেশে প্রবেশ করছে, তার অতি সামান্য অংশই উদ্ধার করা যাচ্ছে।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যত মাদক বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে, তার শতকরা মাত্র ১০ ভাগ উদ্ধার হয়। তবে আমাদের দেশে উদ্ধারের পরিমাণ আরও কম।
গত কয়েকদিন ধরে ইত্তেফাকে মাদক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর মাদকবিরোধী অভিযানে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের অনেকে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন। তারা বলেন, মাদক দেশে আসে বলেই এর চাহিদা বেড়ে যায়। স্থল, নৌ ও আকাশ পথে দেশে মাদক প্রবেশ করছে। এই তিন পথে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের বড় ঘাটতি রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা মাদক পাচারের সাথে জড়িত। মাদকের গডফাদারদের সাথে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে মাদক ব্যবসার টাকার ভাগাভাগি হয়। এ কারণে মাদক প্রবেশ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া মাদক ব্যবসার সঙ্গে দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলের এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতাকর্মী জড়িত রয়েছেন। তাদের আয়ের মূল উৎস এই মাদক।
রাজধানী থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত মাদক ব্যবসা পরিচালনার পৃষ্ঠপোষক হন এসব রাজনৈতিক নেতা। আর মাদকের টাকার ভাগ প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার পকেটেও যায়। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির কর্মকর্তাও মাদকের টাকার ভাগ পান। কাউকে ভাগ না দিয়ে এই ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। মাদকের একটি চালান পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার দেখিয়ে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় ২০টা চালান দেশে চলে আসে। এ কারণে এই অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ হাজার। এদের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, মিল-কারখানা নেই, কিংবা চাকরিও করেন না। অথচ তারা দামি বাড়িতে থাকছেন। দামি গাড়িতে চলাচল করছেন। এই ধরনের ব্যক্তিদের অর্থের উৎস সন্ধান করছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ একাধিক সংস্থা। এরমধ্যে চার জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়েছে। আরও অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা অভিন্ন কণ্ঠে বলেন, মাদক নির্মূল করতে হলে যারা দায়িত্বরত রয়েছেন, তাদের সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। সবাইকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে- ‘দেশে মাদক প্রবেশ করতে দেবো না।’ মাদক থেকে যারা ঘুষ নেন, তারা জানতে পারেন না তাদের নিজেদের সন্তানরাও মাদকের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। মরণব্যাধিসহ সকল রোগের মূল কারণ মাদক। অপরাধ বৃদ্ধিরও অন্যতম কারণ মাদক। অর্থাৎ সকল ধ্বংসের মূলেই মাদক। বাংলাদেশে এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে মাদক নেই। এরকম পরিবেশেই আমাদের সন্তানদের অবস্থান। যেকোন মুহূর্তে এই সর্বনাশা মাদকে আসক্ত হতে পারে আপনার সন্তান। তাই মাদকের সাথে কেউ আপোষ করবেন না। অভিভাবকদেরও মাদকের বিরুদ্ধে একই ধরনের মনোভাব থাকতে হবে। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সমন্বয়ে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে।
থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশে সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসমূহ ও জনগণ এক সঙ্গে মাদক নির্মূলে অংশগ্রহণ করেছেন বলে তারা সফল হতে পেরেছেন। বাংলাদেশকে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া তরুণ সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। প্রতিদিন এত বেশি সংখ্যক মাদকাসক্ত রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে চিকিৎসক হয়েও তারা ভীতসন্ত্রস্ত। তাই সকলের কাছে তাদের আবেদন- মাদক নিয়ে কেউ আপোষ করবেন না।