মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ফরিদুর রেজা সাগর

সম্পর্কের জাল বোনা এক মানুষ

আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:৫৮

আজ ৬৮ তে পা রাখছেন বরেণ্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর। সাহিত্যে-শিল্পকর্মে তার বিস্তৃত অবাধ। ৯ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, একুশে পদক সহ আন্তর্জাতিক একাধিক সম্মাননা। সাফল্যের চুড়ায় অবস্থান করেও এক নির্মোহ শিল্পিত জীবন পার করেন তিনি।

তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন তার কাছের মানুষ নায়ক রাজ রাজ্জাক, চিত্রনায়ক ফারুক, নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন, আফজাল হোসেন, কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব তসলিম আহমেদ। ফরিদুর রেজা সাগরের জন্মদিনে তাদের অবলোকন নিয়েই আজকের মূল প্রতিবেদন।

অবলোকন-১
সে সময় রাবেয়া খাতুনের একটি বই বের হবে। বইয়ের নাম ‘ফেরারী সূর্য’।  আমাকে নিয়ে গেলো ফরিদুর রেজা সাগর, তার মায়ের বইয়ের প্রচ্ছদ করার জন্য। বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত শিল্পীকেই তিনি নিয়ে যেতে পারেন তার বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য, কিন্তু তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন। সাগর আর আমার সম্পর্কের শুরুর কালে ও নিয়ে ওর বাবার সামনে আমাকে দাঁড় করালেন। সাগর বললো, ‘আমার বন্ধু আর্ট কলেজে পড়ে। ও কী আঁকতে পারেনা কাভারটি?’ একে তো হচ্ছে বইটি ওর মায়ের। আরেকদিকে আমি এক অখ্যাত শিল্পী। সেই আমি যদি তার বইটি আঁকি! 

ওর বাবাও বলে দিলেন- হ্যা করো। আরো বললেন,‘ট্রান্সপারেন্সি দিয়ে একটি কাভার কীভাবে করা যায় ভাবো। ভেবে এসো। তারপরে করলাম। এই যে কাজটি করা হলো। এই যে সম্পর্কের প্রতি যে আলাদা যতœ নেয়া। এই বিষয়টি একজন ফরিদুর রেজা সাগর জানেন। এখনও যদি টেলিভিশনে কিছু করি, সেই উৎসাহের জায়গাটি সে। নিজে থেকে কোথাও যাই না কিছু করতেও চাই না। যা কিছু করি, পেছনে ও আছে। ও করায়। সে যদি এগুলো না করাতো, কিছুই হতো না। শিল্পীর যে স্বত্ত্বাটি আমার মাঝে তা ওর কারণেই বেঁচে আছে।-
আমার এক সাক্ষাৎকারে দেশের বরেণ্য অভিনেতা-নির্মাতা আফজাল হোসেন কথাগুলো বলেছিলেন। ফরিদুর রেজা সাগর ও আফজাল হোসেনের ভেতরকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক দীর্ঘ কয়েকযুগের। শুধু কি আফজাল হোসেন। আজ এই শিল্পাঙ্গনের অগনিত মানুষকে অনুপ্রেরণা দেবার মানুষটির নামই ফরিদুর রেজা সাগর। 

চিরকাল বন্ধু বৎসল থাকার যে কাজটি তিনি করে গেছেন তা অতুলনীয়। আশির দশকে গুলিস্তানের মোড়ে যে বিখ্যাত খাবারের দোকানটা ছিল সেই রেস্তোরাটা মূলত খাবারের সুস্বাদের জন্য তো পরিচিত ছিলই, কিন্তু জায়গাটি কালোত্তীর্ণ হয়েছে অমলিন বন্ধুত্বের সমীকরণে। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির একদল লেখক, শিল্পী, নির্মাতাদের তখনকার সন্ধ্যায় মূল আড্ডা হতো সেই খাবারঘর-এই। ঘড়ির কাঁটা থেমে যেতো। যুবক ফরিদুর রেজা সাগর তখন হোটেলের তদারকিতে ব্যস্ত। তিনি মাঝে মাঝে এসে বন্ধুদের খোঁজ নিতেন। কিছু লাগবে কী না? এমন মায়ায় জড়িয়েই রাখতে পারে যে মানুষ- তার বন্ধুভাগ্য যে ঈর্শ্বনীয় হবে এটাই স্বাভাবিক। 

অবলোকন - ২
নায়ক রাজ রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘কেউ চাইলেও ফরিদুর রেজা সাগর হওয়া সম্ভব না। প্রত্যেকটা আর্টিস্টকে সে যেভাবে সম্মান দেয়, বা তাদেরকে নিয়ে ভাবে। এটা হয়ত যে তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। কিন্তু ওর ভেতরে একটা পারিবারিক আত্মা আছে। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে পারার একটা প্রবণতা আছে। এটা অনেকে দেখাতে চায়, কিন্তু অনুধাবণ করতে পারেনা। সাগর তা করে। কারণ এটাই ওর পারিবারিক শিক্ষা।’ 

নায়ক রাজ রাজ্জাককে আমরা দেখতাম অন্য কোনো টিভি চ্যানেলে সেভাবে না গেলেও চ্যানেল আই বা ফরিদুর রেজা সাগরের নাম শুনলে না করতেন না। এখানেই সম্পর্ক আর শ্রদ্ধা-ভক্তির জোর।

অবলোকন-৩
চিত্রনায়ক ফারুক এক ইন্টারভিউতে চ্যানেল আই ও ফরিদুর রেজা সাগর প্রসঙ্গ এলে তিনি বলেছিলেন,‘গোটা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কেউই ভাবে না সাগরের মতো। সবাই সমকালীনদের নিয়ে বাঁচতে চায়। আমি দোষ দিচ্ছি না, হয়ত এটাই নিয়ম। কিন্তু যারা এই নিয়ম ভেঙে সবার কথা ভাবে সে আলাদা হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাবে আলাদা করে খোঁজ নেয়া, মতবিনিময় করা। এই অভ্যেস আমি কারো ভেতরে পাইনি। সকলে তো আমরা নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। সাগর সকাল থেকে অন্যদের নিয়ে ভাবতে থাকে। 
আমার বিভিন্ন সময়ে নেয়া ইন্টারভিউতে এসব উপলব্ধি বলেছেন একজন ফরিদুর রেজা সাগর প্রসঙ্গে। এদেশে শিশু সাহিত্যে তার অবদান অনেক। এর বাইরে ‘ছোট কাকু’ সিরিজটি আমাদের দর্শকমনে এক দারুণ ফ্যান্টাসি তৈরি করেছে। 

অবলোকন-৪
ব্যক্তিজীবনে ফরিদুর রেজা সাগর এদেশের চলচ্চিত্র-সঙ্গীত থেকে শুরু করে শিল্পের বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষের কাছে যেন নিবিড় আশ্রয়ের নাম। নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন বলেছিলেন,‘আমাদের চলচ্চিত্রের রুগ্ন সময় থেকে ফেরার পথ তৈরি করেছিলেন সাগর ভাই। ছোট বাজেটের হলেও ঐ সময় ভাল মানের চলচ্চিত্র নির্মানের ধারাবাহিকতায় থাকতোনা যদি একজন সাগর বা ইমপ্রেস টেলিফিল্ম সেই হালটি না ধরতো।’
এই নির্মাতার শেষ জীবনেও পারিবারিক নানান সুবিধা-অসুবিধায় খোঁজ নিয়েছেণ ফরিদুর রেজা সাগর। শুধু শহীদুল ইসলাম খোকন নন। এমন উদাহরণ একাধিক নির্মাতা শিল্পীর ক্ষেত্রে বলা যাবে।’

অবলোকন-৫
এদেশের সঙ্গীতের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড। যার ভাবনা ফরিদুর রেজা সাগরের। টেলিকম প্রতিষ্ঠান সিটিসেল এর সাথে শুরু হয়েছিল সেই যাত্রা। ফরিদুর রেজা সাগর প্রসঙ্গে সিটিসেল এর তৎকালীন কর্তাব্যক্তি তসলিম আহমেদ বলেন,‘আমি এই মানুষটির ভক্ত না শুধু। তার অনেককিছুই আমি ফলো করি। তার মতো উদ্যোমী তরুণ আমার কম দেখা। তরুণই বললাম। কারণ ভেতরের মানুষটি একেবারেই সদ্য তরুণের মতোই। একবার এক মিটিংয়ে আমি আর সাগর ভাই বসে আছি। তো আরেক রিপোর্টার থাকার কথা ছিল, সে আসতে দেরি করছে। বেশ বিলম্বে আসার পর সাগর ভাই তাকে বললেন, তসলিম সে তো সময় মতোই চলে আসলো। তুমি তো আসতে পারলে না।’

তখন সে জবাবে বললো, উনি তো কর্পোরেট। উনাদের হিসেবটাতো আলাদা।’ সাগর ভাই দারুণ একটা প্রতিউত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘আমাদের ৭ টার সংবাদ তো সাতটার সময়েই অনএয়ার দিতে হয়। সেটা তো ১ সেকেন্ডও দেরি করা চলে না। সেক্ষেত্রে তো আমদেরই বরং সময়জ্ঞ্যানটা বেশি থাকা উচিত। এই হলো সাগর ভাই। আমার কাছে মনে হয় সাগর ভাই সময়ের চেয়েও অনেক এগিয়ে ভাবেন। সে কারণেই চ্যানেল আই সবসময়ের জন্য সমকালীন।’

এরকম অগণিত গুণী মানুষদের নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে হয়ত মহাগ্রন্থ লেখা যাবে। কিন্তু সবকিছুতেই মানুষের সাথে সম্পর্কের বুণন কিভাবে করতে হয় তা তিনি জানেন। ফরিদুর রেজা সাগরের কাছে তাই যখন জানতে চাওয়া হয়। জীবনের অর্থ কী? তিনি সবসময় একগাল হেসে এর জবাব দেন- জীবনের অর্থ হলো, তুমি নিজের জন্য বাঁচতে এ পৃথিবীতে আসোনি। এসেছ-অন্যেও হাতটি ধরার জন্য। অন্যেও কষ্টে ব্যথিত হবার জন্য। অন্যেও সাফল্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য। এই নিয়মে চললে তুমিও তোমার পাশে পাবে অনেককে। আর যে না করবে, সে চিরকাল একা, নি:সঙ্গ। আমি একা বাঁচতে চাইনি। বাঁচতে পারিনা।’

এক অনবদ্য সমস্বরের জীবন যাপন করেছেন ফরিদুর রেজা সাগর। যে যাপনে সম্পর্ক বুনছেন প্রতিনিয়ত, ভালবাসার সুতো দিয়ে!

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন