পেছনে নীল দরিয়া। সামনে প্রশ্বস্ত বেলাভূমি। মাঝ চত্বর জুড়ে ধনুকের মতো বাঁকা কেয়া বন। এ বনের বালুকাবেলায় বসে ক্লাস করছে কিছু শিশু। ওরা সবাই জেলে বস্তির। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের দক্ষিণপাড়া শহীদ শেখ রাসেল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওরা। গত মে মাসের মোখা ঘূর্ণিঝড়ে স্কুল ভবন লন্ডভন্ড হওয়ার পর এভাবেই জোড়াতালি দিয়ে চলছে লেখাপড়া।
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, যা দারুচিনি দ্বীপ বা নারিকেল জিনজিরা নামেও পরিচিত। চারদিকে নীল দরিয়া বেষ্টিত এবং সমুদ্র কন্যা খ্যাত সেন্টমার্টিন দেশের পর্যটন খাতের শীর্ষভূমি হলেও পরিকল্পিত উন্নয়নের অভাবে দ্বীপবাসী নানা মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। হতশ্রীদশা শিক্ষা ব্যবস্থার দরুন বহু শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কোরাল দ্বীপের আয়তন আট বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। পুরো দ্বীপ ৯টি গ্রামে বিভক্ত।
প্রাথমিক শিক্ষার জন্য এখানে জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজিস্ট্রিপ্রাপ্ত দক্ষিণপাড়া শহীদ শেখ রাসেল প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বেসরকারি সংস্থা ক্রিড পরিচালিত কোনাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য রয়েছে বিএন ইসলামিক উচ্চ বিদ্যালয়।
জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু জরিপে (২০২৪) স্কুল গমনোপযুগী শিশুর সংখ্যা ১ হাজার ৪৯ জন। এ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ২০২ জন। প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির হার হতাশাব্যঞ্জক। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিন বছর পড়াশোনার পর সরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা। এমতাবস্থায় অঙ্ক ও ইংরেজিতে কাঁচা থাকায় মাধ্যমিকের আগেই বড় অংশ ঝরে পড়ে। এ স্কুলে শিক্ষক পদের সংখ্যা সাত জন। কর্মরত প্যারা শিক্ষকসহ তিন জন। যুগের পর যুগ ধরে শিক্ষক পদ শূন্য থাকে। শাস্তিমূলক বদলি ছাড়া কেউ এখানে চাকরি করতে চায় না। দ্বীপের শিক্ষার হার ৪২ শতাংশ। দক্ষিণ ও কোনাপাড়ায় বিত্তহীন ও অশিক্ষিতের সংখ্যা বেশি। জেলেপাড়ার শিশুদের পড়ালেখার জন্য দেড় যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ শেখ রাসেল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দীর্ঘদিন ধরে চার জন শিক্ষক বিনা বেতনে কাজ করছেন। গত বছরের মোখা ঘূর্ণিঝড়ে টিনের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বর্ষাকালে ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। অন্যান্য সময় বালুকাবেলায় কেয়া গাছের নিচে চলে পড়ালেখা।
মোটেল ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান জানান, দ্বীপের অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র ও অশিক্ষিত। পর্যটন মৌসুমের আয় দিয়ে সারা বছর জীবিকা নির্বাহ করে। অভিভাবকরা লেখাপড়ার চেয়ে শিশুদের দিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরানো, পর্যটন মৌসুমে স্টিমার ঘাটে মুটে বহন, হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ অথবা রিকশা ভ্যান চালানোর কাজে লাগায়। ফলে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে।
দক্ষিণপাড়া শহীদ শেখ রাসেল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মালেক জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার এবং বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নামে দেশের ২৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০১৭ সালে জাতীয়করণের আওতায় আসে। বাদ পড়ে শুধু গরিবের বিদ্যালয় বলে পরিচিত দক্ষিণপাড়া শহীদ শেখ রাসেল স্কুল। এমনিতেই দ্বীপ শিশুরা পড়াশোনা করতে চায় না, তদুপরি জাতীয়করণ না হওয়ায় এবং ভবন সমস্যায় স্কুলবিমুখ হচ্ছে তারা। তিনি বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র জুবাইর জানায়, স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে অনেক দ্বীপ শিশুর পড়ালেখা থেমে যাবে। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেউ পড়তে যাবে না।
মেডিসিন ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান জানান, দেশের মূল ভূখণ্ডে প্রতিটি গ্রামে একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য পীড়িত সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯ গ্রাম মিলে মাত্র একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু তাহের জানান, এখানকার শিশুদের ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশের বেশি। মূল ভূখণ্ডে চর ও পাহাড়ে কর্মরত শিক্ষকরা বাড়তি ভাতা পান। কিন্তু এখানকার শিক্ষকরা দ্বীপ ভাতা পান না। এখানকার জীবনযাত্রা খুবই ব্যয়বহুল। বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কেউ চাকরি করতে চায় না। সবাই বদলির প্রতীক্ষায় থাকে। দ্বীপের একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বি এন ইসলামিক হাইস্কুলে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। ভবনের অভাবে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি যেন দ্বীপে এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্র চালু হয়।
টেকনাফ উপজেলা শিক্ষা অফিসার গৌরচন্দ্র দে জানান, প্রাথমিক শিক্ষায় কিছু সমস্যা রয়েছে। সেসব উত্তরণের চেষ্টা চলছে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. মুজিবর রহমান জানান, ৬, ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় দ্বীপের শত শত শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শহিদ শেখ রাসেল বেসরকারি স্কুলটি জাতীয়করণের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।