শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মশা কীভাবে এত শক্তিশালী হয়ে উঠছে

আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩০

মানবশরীরের জন্য ক্ষতিকারক ভাইরাস ও প্যাথোজেন বহনকারী কিউলেক্স ও এডিস মশার ঘনত্ব ও দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে বেড়েই চলেছে ভয়ংকর রোগ ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গসহ সবাই শঙ্কিত। তবে পলিসিগত কাঠামোর বিনির্মাণ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আগে পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে হবে বর্তমানে কিউলেক্স ও এডিস প্রজাতির মশা-ই আমাদের এই নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করে চলছে। তাহলে এডিস মশার ইকোলোজি ও কিউলেক্স মশার ইকোলোজি অর্খাত্ এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র এবং কিউলেক্স মশার প্রজনন ও বেড়ে ওঠার পরিবেশের ভিন্নতা কেমন। তাদের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার পরিবেশের ওপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হবে। এডিস মশা নিয়ে এত বেশি আলোচনা হয়েছে যে, এই মশার ডিম পাড়া থেকে শুরু করে ডিমের স্থায়িত্ব ও ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়ে পিউপাতে পরিণত হতে কত সময়ের প্রয়োজন ও এতে কী ধরনের পরিবেশের প্রযোজন হয়, তা সবারই জানা। তার পরও বলছি, এই মশা ছায়াযুক্ত স্থির পানিতে যে কোনো সূক্ষ্ম বাহনের ওপর ডিম পাড়ে। পানি অবশ্যই স্বচ্ছ পরিষ্কার, কিন্তু ব্যাকটেরিয়াযুক্ত হতে হবে। একইভাবে আর্টিফিশিয়াল পানিযুক্ত কনটেইনার, নারিকেলের মালাই, টায়ার, ফুলের টব, নির্মাণাধীন বাড়ির নিচে জমানো পানিতে, গ্যারেজে গাড়ি ধোয়ার স্থানে জমে থাকা পানিতে, গাছের ছিদ্রের মধ্যে, পাতার গোড়ায় (লিফ এক্সইলে) ব্যাম্বো স্ট্রাম্পে প্রভৃতি স্থানে এই এডিস মশা বংশ বিস্তার করতে পারে। অন্য দিকে কিউলেক্স মশার জৈবিকভাবেই দূষিত পানিতে প্রজনন ও বংশবিস্তার ঘটায়। এই মশা সাধারণত ঘোড়া ও গোশালায় মনের আনন্দে প্রজনন ঘটায় ও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করে। একই ভাবে খোলা পায়খানা, সেপটিক ট্যাংক, ফ্লাডেড পিট ল্যাট্রিন, বদ্ধ নালা, ম্যানহোল দূষিত লেক, প্রভৃতি জায়গা এই মশার উত্তম প্রজনন স্থান। এখন পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, এডিস ও কিউলেক্স মশার উপদ্রব থেকে পরিত্রাণের জন্য তাদের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার উত্স মূলত পতন করতে হবে।

আর তাই এই চিহ্নিত স্থানগুলো পরিপূর্ণভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখতে হবে। রাখতে হবে দূষণমুক্ত। এডিস মশা যেমন পরিচ্ছন্ন পরিবেশের জমানো পানিতে পাওয়া যায়, উলটোদিকে কিউলেক্স দূষিত পরিবেশের জমানো পানিতে পাওয়া যায়। এখন যদি ঢাকা শহরের কথাই চিন্তা করি, তাহলে বাস্তবতা কী দেখতে পাই। যেসব পাবলিক প্লেসে গণশৌচাগার আছে, সেখানে পরিবেশ কতটা কিউলেক্সের প্রজননের জন্য উপযোগী। যে ড্রেন ও ডিচেসগুলো ব্লক হয়ে পরিত্যক্ত ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, ঐখানে যে শুধু কিউলেক্স মশাই তৈরি হচ্ছে তা নয়, জন্ম নিচ্ছে অন্যান্য প্যাথোজেন ও রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু। যে লেকগুলোতে বহুদিন বদ্ধ পানি রয়েছে এবং সাধারণ জনগণ নির্দ্বিধায় ময়লা-আর্বজনা ফেলছে, সেই লেকগুলো কিউলেক্স মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। যেমনভাবে বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত গাড়ি, রেলের পরিত্যক্ত বগি, পরিত্যক্ত ও নির্মাণাধীন ইমারত পরিণত হয়েছে এডিস মশার কারখানায়। এই প্রজনন ক্ষেত্রগুলো কি দিনদিন বাড়ছে, না কমছে তা আপনাদের বিচারে ছেড়ে দিলাম। এবার আসি মশক দমন পদ্ধতিতে। মশার টেকসই দমন পদ্ধতির নাম হলো আইভিএম বা ইন্টিগ্রেটেড ভেকটর ম্যানেজমেন্ট বা সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। যে পদ্ধতির মধ্যে সব দমন পদ্ধতির একটি সমন্বয় থাকবে।

অর্থাত্ শুধুই রাসায়নিক পদ্ধতি কখনোই টেকসই পদ্ধতি হতে পারে না। রাসায়নিক পদ্ধতি অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে একটি যুক্তিসংগত পদ্ধতি হতে পারে। কিন্তু একমাত্র পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করলে তা হবে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। আমরা মশা দমন পদ্ধতি হিসেবে শুধুই কীটনাশক (লার্ভিসাইড ও এডালটিসাইড ) প্রয়োগেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। যার ফলে মশার দমন না হয়ে বৃদ্ধি হচ্ছে। যার প্রতিফলন ২০২৩ সালের প্রি-মুনসন ও মুনসন-এ সিডিসি কর্তৃক পরিচালিত লার্ভার বিআই এবং এইচআইয়ের ঘনত্ব হতে সুস্পষ্ট। আর এই লার্ভিসাইড ও এডালটিসাইড শুধুই এডিস মশা দমনের জন্যই করা হচ্ছে। কিউলেক্স মশাকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ায় তার আধিক্যে আমরা এখন দিশেহারা। বিষয়টি নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত ভয়াবহ ফলাফল লক্ষণীয়।

কীটনাশক প্রয়োগ যদি যথাযথ ডোজ অর্থাত্ এলডি-৫০ বা এলসি ৫০-এর সঠিক মাণ পরিমাপ না করেই প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা কখনোই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দেবে না, বরং বিপরীত ফলাফল প্রদান করবে। মূল্যমাণগুলো নির্ধারণ ও নির্দিষ্টকরণ নির্ভর করে কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তদারকির ওপর, প্রয়োগকারীর অসাবধনতা বা অজ্ঞতার কারণে, প্রয়োগে ব্যবহূত মেশিনের সঠিক ক্যালিব্রেশনের অভাবে, প্রয়োগের সঠিক সময় নির্ধারণের অভাবে, প্রয়োগের সঠিক স্থানের অভাবে ও প্রয়োগের গতি প্রকৃতির ওপর আর সর্বোপরি জলবায়ুর পরিবর্তন। এখন এই লিথাল ডোজ যদি ওপরের কারণগুলোর জন্য সাব-লিথাল ডোজে পরিণত হয়, তাহলে যে ভয়ংকর পরিণতির সৃষ্টি হবে তা হলো— মশা প্রতিরোধী হয়ে উঠবে এবং ঐ কীটনাশকে আর মশা মারা যাবে না।

মশার শরীরবৃত্তীয় নানা রকম পরিবর্তন সাধিত হবে। যেমন, যে মশাগুলো সাধারণত এন্ডোফিলিক আচরণের ছিল, তারা এক্সোফিলিক হয়ে উঠবে। অর্থাত্ যারা রক্তপান করে আবাসভবনের ভেতরে বিশ্রাম করত তারা কীটনাশক প্রয়োগের সময়ের বিপরীতে আবাস ভবনের বাইরে অবস্থান নেবে, আবার প্রয়োজনে আবাস ভবনের ভেতরে অবস্থান  নেবে। তাদের ডিম পাড়ার স্থান ও সময় দুটোই পরিবর্তন করবে। তাদের মিলিত হওয়ার সময় ও স্থানও পরিবর্তন করবে।

মশার শরীরে কীটনাশকের সাব-লিথাল ডোজ ডি টক্সিফায়িং এনজাইমের সৃষ্টি করে কীটনাশকের বিষক্রিয়া নষ্ট করে দেবে। এই মশার পরবর্তী বংশধর আর ঐ কীটনাশকের দ্বারা কোনোভাবেই মারা যাবে না।

ঐ সাব লিথান ডোজে মশা মারা না গেলেও যে প্রকৃতিক শত্রু আছে, তারা মারা গিয়ে মশা শত্রুমুক্ত হয়ে যাবে। যাতে করে মশার ঘনত্ব দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পাবে।

মশার শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ফলে মশার মধ্যে বেড়ে ওঠা ভাইরাসও তারা চারিত্রিক পরিবর্তন বা জিন মিউটেশন ঘটায়ে স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবেশে ভিরুলেন্স শক্তি দ্বিগুণ করে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দেবে।

জলবায়ুর পরিবর্তন ও মশার এবং ভাইরাসের দ্বিগুণ উত্সাহ-উদ্দীপনায় ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। যার ফলে এই ধরনের করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে দেশে কোনো উন্নত গবেষণাগার ও গবেষক তৈরির বিষয়টি আমরা বেমালুম ভুলে আছি।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিত্সা প্রতিষ্ঠান, নিপসম বরাবরই এই ধরনের জাতীয় জনস্বাস্থ্যবিষয়ক ইস্যুগুলো নিয়ে সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই এই জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে নিপসমকে ‘সেন্টার ফর এক্সোলেন্সি অব এলিমিনেশন অব ভেকটর বর্ন ডিজিজেস’ ঘোষণার জোর প্রস্তাব করছি।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিত্সা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা

ইত্তেফাক/এমএএম