বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১
The Daily Ittefaq

সাবেক এমপি পাপুলের শ্যালিকাসহ ৩ জনের নামে দুদকের মামলা

আপডেট : ১৬ মে ২০২৪, ১৬:৩২

প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্ন ও রেজিস্ট্রার ঘষামাজা করে আয়, সম্পদ ও পারিবারিক ব্যয়ে পরিবর্তন করার অভিযোগে লক্ষীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন ও কর অঞ্চল-৪ এর উপ-কর কমিশনার খন্দকার মো. হাসানুল ইসলামসহ তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার অন্য আসামি হলেন, কর অঞ্চল-৮ এর উচ্চমান সহকারী হিরেশ লাল বর্মণ। 

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান । দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)

এজাহার সূত্রে জানা যায়, জেসমিন প্রধান ২০২১ সালের শেষের দিকে কোনও এক সময় কর সার্কেল-১৬৫, কর অঞ্চল-০৮, এর অফিসে কর্মরত কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ২০১৬-২০১৭ করবর্ষ থেকে ২০২০-২০২১ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন একই দিনে তড়িঘড়ি করে দাখিল করেন। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের চোখে ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কর সার্কেলের যাবতীয় রেজিস্টারে ঘষামাজা করে টাকার অঙ্ক পরিবর্তন-পরিমাজন হয়েছে। যার প্রমাণ মিলেছে দুদকের জব্দ করা নথিপত্রেও।

জেসমিন প্রধানের ২০১৬-২০১৭ থেকে ২০২০-২০২১ করবর্ষ পর্যন্ত মোট পাঁচ করবর্ষের আয়কর রিটার্নগুলো রিটার্ন রেজিস্টারে যথাক্রমে ৮৬৮, ৬৫৩, ৭৮০, ১১০১ এবং ৫৬ নং ক্রমিকে এন্ট্রি হয়। রিটার্ন রেজিস্টারের রেকর্ড হতে দেখা যায়, (১) মোট আয়ের কলামে ঘষামাজা, (২) ৭৪ ধারার কর কলামে ঘষামাজা, (৩) ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ কলামে ঘষামাজা, (৪) হাতে নগদ ও ব্যাংক স্থিতি কলামে ঘষামাজা, (৫) রিটার্ন রেজিস্টারে নিট সম্পদ কলামে ভিন্ন হাতের লেখায় বিভিন্ন সংখ্যা বসানো, (৬) রিটার্ন রেজিস্টারে পারিবারিক ব্যয়ের যে তথ্য লেখা রয়েছে, আয়কর রিটার্নে এর ভিন্নতা পাওয়া গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)

আয়কর নির্ধারণী আদেশপত্রে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর রিটার্ন দাখিলের তারিখেই করদাতাকে ওই মাসের ৩১ তারিখে শুনানির জন্য ৭৯ ও ৮৩(১) ধারায় নোটিশ জারি করা হয়েছিল। সার্কেল কর্মকর্তা খন্দকার মো. হাসানুল ইসলামের কাছে করদাতার পক্ষে আয়কর আইনজীবী মো. আদনান শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানি শেষে ২০২০-২০২১ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। 

নথি অনুসারে, ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সাধারণ ধারায় রিটার্ন দাখিল করলেও রিটার্নের সঙ্গে ৭৪ ধারায় প্রদেয় আয়কর ছিল নয় লাখ ৬৮ হাজার ১২৫ টাকা। যদিও ওইদিন কর দাখিল হয়নি, পরবর্তী সময়ে ১৪ ডিসেম্বর পে-অর্ডারে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের গুলশান শাখার মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন। আয়কর নথিতে খন্দকার মো. হাসানুল ইসলাম অনুস্বাক্ষরিত ও ক্যানসেল লেখা চারটি চেক সংরক্ষিত জব্দ করা হয়েছে। যা বৈধতা নিয়ে সন্দেহ থেকে গেছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-২০১৭ করবর্ষের ৩০ নভেম্বর চালানের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা, ২০১৭-২০১৮ করবর্ষের ২৯ নভেম্বর পাঁচ হাজার টাকা, ২০২৮-২০১৯ করবর্ষের ২ ডিসেম্বর চেকের মাধ্যমে ১৫ হাজার ৬০০ টাকা পরিশোধিত হয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইস্যুকৃত চেকের এক লাখ ৪৭ হাজার টাকা, ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বরের তিন লাখ ৭৯ হাজার ৬৯ টাকার চেক, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর ইস্যু করা চেকের ছয় লাখ ৭৩ হাজার ২৬২ টাকা এবং ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি নয় লাখ ৬০ হাজার ৬২৩ টাকার চেক জমা হয়নি। ওই চারটি চেক সরকারি কোষাগারে জমা না হওয়ার কারণ ওটা ছিল পরবর্তী সময়ে দাখিল করা বলে দুদক মনে করছে।

করদাতার স্টক রেজিস্টার ও মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টার পর্যালোচনায় দেখা যায়, করদাতার ২০১৬-২০১৭ করবর্ষে ৮২বিবি ধারায় তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০১৭-২০১৮ করবর্ষে ৮২বিবি ধারায় তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০১৮-২০১৯ করবর্ষে ৮২বিবি ধারায় চার লাখ ৫০ হাজার এবং ২০১৯-২০২০ করবর্ষে ৮২বিবি ধারায় চার লাখ ৫০ হাজার টাকা মোট আয় লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। কিন্তু আয়কর রিটার্নে ২০১৬-২০১৭ করবর্ষে ৮২বিবি ধারায় আয় ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০১৭-২০১৮ করবর্ষে ৮২বিবি ধারায় আয় ২১ লাখ ৫০ হাজার, ২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ করবর্ষে ওই একই আয় ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার এবং ৪৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ করদাতার আয়কর রিটার্নের সঙ্গে স্টক রেজিস্টার এবং মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টারের কোনও মিল পাওয়া যায়নি।

এ অবস্থায় জেসমিন প্রধান কর অঞ্চল-৮ এর কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে ২০১৬-২০১৭ করবর্ষ থেকে ২০২০-২০২১ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন একই দিনে করে দাখিল করে সার্কেলের যাবতীয় রেজিস্টারে ঘষামাজা করে টাকার অঙ্ক পরিবর্তন-পরিমার্জন করেছেন। ওই সার্কেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্বারা রিটার্ন রেজিস্ট্রার ঘষামাজা করে মোট আয়, মোট সম্পদ, নিট সম্পদ, পারিবারিক ব্যয় ইত্যাদির পরিবর্তন করার সঙ্গে আসামিদের সরাসরি জড়িত ছিলেন বা দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে। যে কারণে মামলায় দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। 

লক্ষীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল

প্রসঙ্গত, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল এবং তার স্ত্রী এমপি সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর মামলা করে দুদক। আসামিদের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ১৪৮ কোটি টাকার লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয় মামলায়। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল। পরে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হন।

অর্থ ও মানবপাচার এবং ঘুষ প্রদানের অভিযোগে ২০২০ সালের জুন মাসে কুয়েতে গ্রেপ্তার হন পাপুল। ওই মামলার বিচার শেষে ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি তাকে চার বছরের কারাদণ্ড দেয় কুয়েতের একটি আদালত। কুয়েতের রায়ের নথি হাতে পাওয়ার পর ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাপুলের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে জাতীয় সংসদ।

ইত্তেফাক/এনএ