বর্তমান এই ডিজিটাল যুগে ফ্রিল্যান্সিং শব্দটি শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া একটু কঠিনই হবে। ফ্রিল্যান্সিং বলতে বোঝায় মূলত মুক্ত পেশাকে। যেখানে কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সময়ের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ব্যক্তি তার নিজ দক্ষতা দিয়ে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশবিদেশে যে সেবা দিয়ে থাকে, তাকেই ফ্রিল্যান্সিং বলে। আর যে ফ্রিল্যান্সিং করে তাকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সার। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। একটি সূত্রমতে, এ দেশের প্রায় ১০ লাখ তরুণ-তরুণী এই মুক্ত পেশার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও এ দেশের অধিকাংশ ফ্রিল্যান্সারের জানা নেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে ইসলাম কী দিকনির্দেশনা দিয়েছে কিংবা উক্ত পেশায় হারাম দিকগুলো কী কী।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের ইসলামী নীতিমালা ফ্রিল্যান্সিং জগতে কাজের পরিধি অনেক ব্যাপক। তবে যেসব ক্যাটাগরিতে বেশি কাজ করা হয়ে থাকে সেগুলো হলো- গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডেটা এন্ট্রি, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ভার্চুয়াল অ্যসিস্ট্যান্ট ইত্যাদি। একজন ফ্রিল্যান্সার, সে যে ক্যাটাগরিতেই কাজ করুক না কেন, তার জন্য ইসলাম কিছু সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যেগুলো পরিত্যাগের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সার হালালভাবে তার জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। নিম্নে ফ্রিল্যান্সিংয়ের হারাম দিকগুলো তুলে ধরা হলো-
ক. মূল কাজটি হালাল না হওয়া: যদি কেউ এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ফ্রিল্যান্সিং করে, যাদের উৎপাদিত পণ্য বা কাজ ইসলাম মূলগতভাবে হারাম করেছে, তাহলে সে উপার্জন হালাল হবে না; যেমন: কেউ এমন একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ডেটা এন্ট্রি করল, যারা মদ উৎপাদন করে কিংবা কোনো ওয়েব ডেভেলপার এডাল্ট সাইটের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে দিলো-এ সবই হারামের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ আল্লাহ বলেন, 'তোমরা নেক ও তাকওয়ামূলক কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করো। তবে পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে পরস্পর সহযোগিতা করো না (সুরা মায়েদা: ০২)।'
খ. ধোঁকা দেওয়া: ধোঁকাবাজি বা প্রতারণা ফ্রিল্যান্সিং জগতে অন্যতম একটি হারাম কাজ। টাকা নিয়ে অর্ডার ডেলিভারি না দেওয়া কিংবা সঠিকভাবে বাটপারির বহু নজির ফ্রিল্যান্সিংয়ে রয়েছে; যা সম্পূর্ণরূপে হারাম। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয় (সহীহ মুসলিম: ১০২)।'
গ. কপিরাইট লঙ্ঘন করা: অন্যের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ অনুমতি ব্যতীত নিজে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করাকে বলা হয় কপিরাইট লঙ্ঘন। যা অন্যের অধিকার খর্ব করার শামিল। আর এটি ইসলামে হারাম; যেমন: অন্য কারো করা ডিজাইন নিজের বলে দাবি করা। আল্লাহ বলেন, 'হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পদ গ্রাস করো না; কেবল পরস্পর সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করো, তা বৈধ (সুরা নিসা: ২৯)।'
ঘ. অশ্লীলতা ছড়ানো অশ্লীলতা প্রকাশ পায়, এমন যে কোনো ধরনের ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি, ডিজাইন, লোগো কিংবা মার্কেটিং নিষিদ্ধ; যেমন: পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য কিংবা নাটক-সিনেমার থাম্বনেইল/পোস্টার ডিজাইন করার ক্ষেত্রে পর্দাহীন নারীর ছবিযুক্ত করা। আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব (সুরা নূর: ১৯)।'
৬. ক্ষতিকর কাজ করা কেউ ব্যক্তিস্বার্থে ফ্রিল্যান্সিংয়ে এমন কোনো সার্ভিস দিলো, যা অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য ক্ষতির কারণ হয় তবে তা হারাম; যেমন: টাকার বিনিময়ে কারো জন্য ফিশিং (Phishing) লিংক তৈরি করে দেওয়া। আল্লাহ বলেন, 'যারা বিনা অপরাধে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা অবশ্যই মিথ্যা অপবাদ এবং স্পষ্ট অপরাধের বোঝা বহন করে (সুরা আহজাব ৫৮)।' রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'প্রকৃত মুসলিম সেই, যার মুখ ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদে থাকে (সহিহ বুখারি: ৯)।'
চ. ওয়াদা ভঙ্গ করা অনিবার্য কারণ ব্যতীত ক্লায়েন্টকে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর অর্ডার সাবমিট না করা, ক্লায়েন্টকে দেখানো কাজের স্যাম্পলের সঙ্গে নিজের করা কাজের মিল না থাকা ইত্যাদি ওয়াদা ভঙ্গের নামান্তর। আর একজন মুসলিম সে কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারে না।
আল্লাহ বলেন, 'হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ওয়াদাগুলি পূর্ণ করো (সুরা মায়েদা: ১)।' আর রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, 'চারটি স্বভাব যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে খালিস মোনাফিক বলে গণ্য হবে। ১. যে কথা বলার সময় মিথ্যা বলে, ২. যখন অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে, ৩. প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে, ৪. যখন বঝগড়া করে গালমন্দ করে। যার মধ্যে এগুলোর কোনো একটি স্বভাব পাওয়া যাবে, তার মধ্যে নিফাকের একটি স্বভাব পাওয়া গেল, যে পর্যন্ত না সে পরিত্যাগ করে (সহিহ বুখারি: ২৯৫৪)।'
পরিশেষে, মুসলিম ফ্রিল্যান্সার ভাই-বোনদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনারা হারাম থেকে দূরে থাকুন। হালালভাবে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার গড়ে তুলুন। কারণ হারাম উপার্জনে গঠিত শরির জান্নাতে যাবে না। (দেখুন- তিরমিজি: ৬১৪) আল্লাহ আমাদেরকে হারাম থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন, আমিন।
লেখক: এমফিল গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া