ধোঁয়া-ধূলিকণা বা বায়ুদূষণের সঙ্গে আমাদের চোখের ক্রমাগত সংস্পর্শে বাড়ছে শুষ্ক চোখের সমস্যা। এর সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রায় যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস, যা শুষ্ক চোখের সমস্যাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোখের ড্রাইনেস বা শুষ্কতা বর্তমানে একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ১০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই সমস্যার শিকার। দক্ষিণ এশিয়া বিশেষত বাংলাদেশে এই সমস্যার প্রাদুর্ভাব আরও উদ্বেগজনক।
ঢাকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। গবেষণায় বায়ুদূষণ, দীর্ঘ সময় স্ক্রিন ব্যবহার এবং জলবায়ুর পরিবর্তন এই সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শুষ্ক চোখ এক ধরনের চোখের সমস্যা। আমাদের চোখের একটি ব্লিংকিং রিফ্লেক্স থাকে। কিন্তু আমরা যখন দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি, তখন সেই ব্লিংকিং রিফ্লেক্সটি নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণ চোখ যখন ব্লিংক করে, তখন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নিয়ম অনুযায়ী ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড থেকে পানি এসে চোখকে ভিজিয়ে দেয়। আর যখন চোখে ব্লিংকিং হবে না, তখন চোখে পানি আসবে না। চোখ ভেজার এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাকে বলে আই ড্রাইনেস।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুষ্ক চোখের সমস্যা দীর্ঘ মেয়াদে চোখের ভিশনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। শুষ্ক চোখের সমস্যা আগে বেশি বয়সীদের মধ্যে দেখা গেলেও এখন দূষিত বায়ু বা ধুলাবালিমিশ্রিত আবহাওয়ার কারণে তরুণদের মধ্যেও এ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের যারা বাইক চালায়, দীর্ঘ সময় এসি রুমে থাকে, যারা ঘুমায় কম, অন্ধকার রুমে স্ক্রিন দেখে, আইটি সেক্টর বা দীর্ঘসময় কম্পিউটারে কাজ করে, তাদের ড্রাই আইয়ের সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এজন্য স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় দেওয়া যাবে না, বিনোদনের জন্য স্ক্রিনের বিকল্প রাখতে হবে এবং বই পড়া বা খোলামেলা স্থানে সময় কাটানোতে অভ্যস্ত হতে হবে।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি: বাংলাদেশে ড্রাই আই-সংক্রান্ত গবেষণা খুবই কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স (ইনআইবিএমআর) পরিচালিত ‘ঢাকা শহরাঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ড্রাই আই সিনড্রোমের প্রাদুর্ভাব’ শীর্ষক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মোট অংশগ্রহণকারীর ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ড্রাই আই সিনড্রোমে আক্রান্ত। যার মধ্যে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি ছিল, যা প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়া অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৬৫ শতাংশ জানান যে, তাদের কাজ স্ক্রিন-নির্ভর এবং প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যাপ্ত পানি পান করেন না। এতে পুরুষ ও নারীর মধ্যে প্রাদুর্ভাবের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়নি। গবেষণায় মোট ১ হাজার ৫০০ জন অংশগ্রহণ করেন। যা ঐ বছর জার্নাল অব ওকুলার ফার্মাকোলজি অ্যান্ড থেরাপিউটিক্সে প্রকাশিত হয়।
দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি :পরিবেশ, জীবনযাত্রার ধরন এবং স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতার কারণে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ড্রাই আই সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। যদিও পুরো অঞ্চলের জন্য এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান সীমিত। তবে বিভিন্ন গবেষণায় এই সমস্যার প্রকোপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় ড্রাই আই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের হার প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। শহরে এলাকায় যেখানে স্ত্রিন ব্যবহারের মাত্রা উচ্চ এবং বায়ুদূষণ গুরুতর, সেখানে এই হার তুলনামূলক বেশি।
ভারতে ৯ হাজার ৭৩৫ জনের মধ্যে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতের শহুরে এলাকায় প্রায় ২২ থেকে ২৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ড্রাই আই সমস্যায় ভোগেন। অন্যদিকে গ্রামীণ এলাকায় এই হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। পাকিস্তানে প্রায় ২৫ শতাংশ শহুরে কর্মজীবী ড্রাই আইয়ে আক্রান্ত। আর শ্রীলঙ্কা ও নেপালে তুলনামূলকভাবে ড্রাই আইয়ের হার কম। কিন্তু উঁচু পাহাড়ি এলাকায় শুষ্ক বাতাসের কারণে এটি একটি প্রধান সমস্যা।
দক্ষিণ এশিয়ার বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ড্রাই আইয়ে আক্রান্ত। এর প্রধান কারণ হলো বয়সজনিত টিয়ার ফিল্ম-ঘাটতি। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ড্রাই আই সমস্যা বাড়তির দিকে, যা ১৫ শতাংশের বেশি। ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহার, অফিসের এয়ার কন্ডিশনিং এবং পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া এর প্রধানতম কারণ।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিভাগের প্রাক্তন প্রধান এবং ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার পাবলিক হেলথ বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. আনিসুর রহমান আনজুম বলেন, শুষ্ক চোখের সমস্যা এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমরা একসময় এটাকে বড়দের সমস্যা বলে জানতাম, কারণ বয়স ৭০ বা তার বেশি হলে চোখের পানি অনেকটা শুকিয়ে যায় কিংবা কমে যায়। কিন্তু এখন অল্প বয়সে শুষ্ক চোখের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এটা ডিভাইস ব্যবহার করার জন্যে হচ্ছে। এখানে পরিবেশও একটা বড় কারণ, এছাড়া ভিটামিন ডি-এর অভাবকেও দায়ী করেন এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘তরুণ বয়সে শুষ্ক চোখের সমস্যা আগে আমরা দেখিনি, এখন একাধিক গবেষণায় অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে।’
ডা. আনিসুর রহমান আনজুম বলেন, যাদের পেশাগত কাজে ডিভাইজ ব্যবহার করতে হচ্ছে, তাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। বহিঃবিশ্বে কোম্পানির কর্মীরা লাঞ্চ ব্রেকের পরও চার বার ব্রেক নেয়, যেটা বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে লাইট অফ থাকবে, বাইরে হাঁটাহাঁটি করবে, ব্যায়াম করবে, ২০ মিনিট কাজ থেকে বিরত থাকবে। এর ফলে তাদের কাজের আউটপুট ভালো আসে। অন্য একটি রুলস আছে—‘২০-২০-২০’। এর মানে তুমি ২০ মিনিট কাজ করো, ২০ ফিট দূরে তাকাও এবং ২০ বার চোখ ব্লিংক করো। যেহেতু অফিস রুমগুলো ছোট, তাই ২০ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে বসে থাকো।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, কম্পিউটারের স্ত্রিন আইবল থেকে ১৫ ডিগ্রি নিচে থাকবে। চোখ থেকে স্ক্রিন ওপরে থাকলে চোখ বেশি খুলে রাখতে হয়, এতে চোখ বেশি ড্রাই হয়। চোখ দুর্বল লাগে, চোখে ঝাপসা দেখা যায়, কাজ করতে করতে দূরে তাকালে পরিষ্কার দেখা যায় না। অতিরিক্ত কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে আর একটি সমস্যা হয়, যার নাম ‘কম্পিউটার ভিষণ সিনড্রোম’ (সভিএস)। শীতকালে শুষ্ক চোখের সমস্যা বেশি হয়, বর্ষাকালে একটু কম হয়।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তারেক রেজা আলী বলেন, শুষ্ক আবহাওয়াতে বা শীতকালে এই শুষ্ক চোখের সমস্যা বেড়ে যায়। তখন চোখে একটা অস্বস্তি ভাব থাকে, চোখ খচখচ করে, তাকিয়ে থাকতে অসুবিধা হয়, চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে, অল্পতেই চোখ লাল হয়ে যায়। ধুলাবালিতে এই রোগ বেড়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের আর্টিফিশিয়াল টিয়ার আছে, যা দিয়ে চোখকে ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে। চোখ পরিষ্কার রাখতে পানির ঝাপটা দেওয়া, বাইরে গেলে কালো চশমা ব্যবহার এবং অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।