মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

শব্দদূষণের পৈশাচিক উদযাপনের সংস্কৃতি বাদ দিতে হবে

  • অতিরিক্ত শব্দের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের ঝুঁকি, মানসিক অস্থিরতা, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে
  • বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণে ইকো সিস্টেমে পোকামাকড় নিজেদের বাঁচাতে অন্যত্র চলে যায় ফলে উদ্ভিদের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটে
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৪

রাজধানীর মিরপুর কালশী এলাকা। পরিবার থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে নববর্ষের শুরুতে লাগাতার আতশবাজির শব্দে অসুস্থ হয়ে পড়ে রায়হান তালুকদার। তিনি হার্টের রোগী ছিলেন, বাইপাস সার্জারি ছিল তার। রায়হান তালুকদারের মেয়ে জানায়, ‘ঐ রাতের এলোপাথাড়ি শব্দে বাবার ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি ছটফট করছিলেন, আমরা শব্দের কারণে ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে রেখেছি, আর বাবা বলছিল আমার কষ্ট হচ্ছে জানালা খুলে দাও। তাকে আমরা মেঝেতে শুইয়ে দিই, যাতে কম শব্দ আসে। পরের দিন তাকে হাসপাতালে নিতে হয় এবং তার দুদিন পর বাবা মারা যান।’ তার মেয়ে বলেন, তিনি অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু সে রাতের পর বেশি অসুস্থ হয়ে মারা যান। 

মোহাম্মদপুর তাজমহল সড়কে হরহামেশায় লেগে থাকে মাইকে উচ্চ শব্দে আওয়াজ। উচ্চশব্দের কারণে মেয়ে শাহিনা আক্তার তার অসুস্থ মাকে শব্দ থেকে বাঁচাতে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও শেষ রক্ষা হয় না মা আতিয়া বেগমের। গ্রামে তিনি অতিশীতে অসুস্থ হয়ে মারা যান। শাহিনা আক্তার বলেন, ‘মা শহরে আমার বাসায় থাকলে, এত ঠাণ্ডায় তাকে অসুস্থ হতে হতো না।’   

পরিবেশবিদরা আতশবাজি ও পটকা ফোটানো মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ থেকে নিজেদের বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘সবুজে ভরা বাংলাদেশে আমরা যোগ করেছি পৈশাচিক উদযাপনের সংস্কৃতি। আতশবাজি পোড়ানোর কারণে অনেক পাখি আতঙ্কে আকাশে ওড়ে। গবেষণায় দেখা যায়, লক্ষ্মীপ্যাঁচা একটি কৃষকের ২৫ লাখ টাকার ফসল রক্ষা করতে পারে। আমাদের স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেন শিশুরা ও তরুণরা বুঝতে পারে যে—অতিশব্দ, আতশবাজি ও ফানুস পোড়ানোর  নেতিবাচক একটি দিক আছে।’ তারা বলেছেন, আতশবাজি ও ফানুসের পরিবর্তে আলোকসজ্জা, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা এবং সীমিত শব্দে দেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছর উদযাপন করা যেতে পারে।

গবেষণার তথ্য :বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের নববর্ষে রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টার বায়ুদূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৬ শতাংশ এবং শব্দদূষণ ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যদিকে ২০২৪ সালের নববর্ষের রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টার বায়ুদূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৫ শতাংশ এবং শব্দদূষণ ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও বায়ুদূষণ মানুষ, পশু-পাখি উদ্ভিদসহ সার্বিক প্রাণ-প্রকৃতির ওপর ব্যাপক খারাপ প্রভাব ফেলে। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে নববর্ষ উদযাপনের সময় ক্যাপস এই বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করে।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, থার্টি ফার্স্ট নাইটে দেশব্যাপী আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেকে বিদ্যমান শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। ইতঃপূর্বে এক থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজির শব্দে ভয় পেয়ে হৃদরোগে ভুগতে থাকা এক শিশুর মৃত্যু হয় বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও, অতিরিক্ত শব্দের কারণে শ্রবণশক্তি ও স্মরণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, কান ভোঁ ভোঁ করা, মাথা ঘোরা, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়া, মানসিক অস্থিরতা, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াসহ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।

আইনে যা বলা আছে :শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬-এর সাত বিধি লঙ্ঘন করে অননুমোদিতভাবে আতশবাজি ও পটকা ফোটালে তা বিধিমালার ১৮ বিধি অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আইনের ব্যত্যয় হলে বা ভঙ্গ করলে প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করার পরিণতি কখনো ভালো হয় না। বায়ুদূষণের ফলে উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। একটি এলাকার বায়ুদূষণ বা শব্দদূষণের কারণে ঐ এলাকার ইকো সিস্টেমে যত পোকামাকড় থাকে, সেগুলো নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য অন্যত্র চলে যায়, যার কারণে উদ্ভিদের প্রজননের ক্ষেত্রেও একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একটি আতশবাজি ফোটানোর কারণে যে এত বড় একটা প্রভাব বিস্তার করে, সেটি আমাদের কল্পনারও বাইরে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ‘নববর্ষ উদযাপনে আতশবাজি ও ফানুস পোড়ানোর প্রচলন যেসব দেশ থেকে শুরু হয়েছিল, তারাই এগুলো পোড়ানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। আতশবাজি না পুড়িয়ে দেশীয় সংস্কৃতি অর্থাৎ নাটক, মঞ্চ নাটক, গান, দেশীয় নাচ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে গিয়েই আমাদের নববর্ষকে বরণ করতে পারি।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. রাশেদুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আতশবাজি আমদানি-রপ্তানি করার ব্যাপারে বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই আইনের প্রচলন রয়েছে কিন্তু এর কোনো সুষ্ঠু প্রয়োগ এখনো লক্ষ করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরেই সরকারিভাবে এসবকে নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করা হচ্ছে। প্রায় প্রতি বছরই নববর্ষের সময়টাতে শত শত অভিযোগ কল আসে ৯৯৯-এ, কিন্তু এখন পর্যন্ত এক জনকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। আইন বা শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দায় এড়ানোর প্রবণতা বন্ধ করে আমাদের আইনের প্রয়োগ করতে হবে।’

ইত্তেফাক/এমএএম