দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ক্যানসার রোগী। প্রতি লাখে ১০৬ জন ক্যানসার আক্রান্ত। নতুন করে ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতি লাখে ৫৩ জন। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশের দায়ী এই ক্যানসার। ৩৮ ধরনের ক্যানসারে মানুষ আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালী ও জরায়ুমুখ ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বেশি। ২০৫০ সালে দেশে ২০২২ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
এদিকে, দেশে ক্যানসার চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই নাজুক। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ছাড়া দেশের অন্য সাতটি হাসপাতালে নামমাত্র ক্যানসার চিকিৎসা সেবা চালু আছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, জনবল ও শয্যাসংখ্যারও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য এ রকম একটি করে ক্যানসার সেন্টার থাকা দরকার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। মানসম্পন্ন চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা দরকার। কিন্তু আছে মাত্র ২২টি। এর মধ্যে যেগুলো উন্নতমানের সেগুলোর বেশির ভাগই ঢাকায় অবস্থিত।
আজ ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য অনন্যতায় ঐক্যতান। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। ক্যানসার সোসাইটির উদ্যোগে রাজধানীতে শোভাযাত্রা ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে।
দেশে প্রথম ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। গত আট মাস ধরে এই হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের কোভাল্ট-৬০ মেশিন নষ্ট আছে। এ কারণে রোগীরা রেডিওথেরাপি দিতে পারছে না। সারা দেশে এই যন্ত্র রয়েছে আটটি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের লিনিয়ার মেশিনটিও কয়েক বছর ধরে নষ্ট। এই মেশিনটি সরিয়ে নতুন একটি মেশিন বসাতে হাসপাতালের পরিচালক মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই হাসপাতালে রোগীদের প্রচুর চাপ। মেশিন নষ্ট থাকায় রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত।
মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালটি ৫০০ বেডের। প্রতিদিন এখানে সহস্রাধিক রোগী চিকিৎসা নেন। বহির্বিভাগে পা ফেলার জায়গা নেই।
জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, যা জনবল আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখানে অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় সীমিত। বহির্বিভাগের রোগীদের সামাল দিতে চিকিৎসকদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে সারা বছর রোগীর ভিড় থাকে। সহজে এ প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা পাওয়া যায় না। ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। আর দরিদ্র রোগীরা বেশি ক্যানসারে আক্রান্ত। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির রোগীরা অনেক ক্ষেত্রে জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। অনেক পরিবার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে নি:স্ব হয়ে পড়ে।
ক্যানসারের রোগী বৃদ্ধির অন্যতম কারণ পরিবেশ ও ভেজাল খাদ্য গ্রহণ। দেশে ভেজাল খাদ্যে সয়লাব। দেড় দশক আগে ‘আমরা কি খাচ্ছি’ শিরোনামে দীর্ঘদিন দৈনিক ইত্তেফাকে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ সময় সরকার থেকে ভেজাল খাদ্য উৎপাদনকারী, বিক্রেতা ও আমদানিকারকসহ সবার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়েছিল। অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যে ভেজাল কিছুটা কমেছিল বলে জানা যায়।
ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলার দাবি জানান চিকিৎসকরা। এতে রাজধানীর হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে এবং রোগীদের ভোগান্তিও কমবে।
শনিবার বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে ‘বাংলাদেশে ক্যানসারের বোঝা : জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি’ শীর্ষক এক গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। প্রধান গবেষক বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খালেকুজ্জামান বলেন, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে এ গবেষণাটি পরিচালিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৬৩১টি পরিবারের দুই লক্ষাধিক অংশগ্রহণকারীকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মোট ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ২১৪ জন।
ফুসফুস, শ্বাসনালী ও পাকস্থলীর ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। গবেষক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘ক্যান্সার বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি। বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি বা নিবন্ধন (পিবিসিআর) না থাকায় প্রতিবেশী দেশগুলোর তথ্য ব্যবহার করে ক্যানসারের পরিস্থিতি অনুমান করতে হয়। ফলে বাংলাদেশে ক্যানসারের সঠিক পরিস্থিতি জানার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আছে। তাই জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বা বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্যান্সারের পরিস্থিতি নির্ণয় করা জরুরি হয়ে পড়েছিল, এজন্যই এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক সময়ে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা দিলে বেশিরভাগ ক্যান্সার রোগী সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসা সবচেয়ে অবহেলিত। এ নিয়ে কেউ গুরুত্বও দেয় না। এ চিকিত্সাব্যবস্থা সম্প্রসারণ করে মানুষের হাতের নাগালে পৌছে দেওয়ার দাবি উঠেছে। যাতে রোগীরা বিদেশে না গিয়ে দেশেই উন্নত চিকিৎসা পেতে পারেন। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।