সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন বা সিআরআইয়ের সিনিয়র অ্যানালিস্ট ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ ও মিডিয়া-উইংয়ের প্রধান তন্ময় আহমেদ প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করে নানাবিধ গুজব ছাড়াতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের আগে যে ক’জনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে চাপে রাখা এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কটূক্তিকর যুক্তি উপস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই দুজন।
নিজেকে আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিলেও, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদের বাবা ফরহাদ রহমান মাক্কি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর কাছে 'মাক্কি রাজাকার' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে নাম লেখান, সরকারের বিভিন্ন পদে চাকরি করেন এবং অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বাবার ছায়া অনুসরণ করেই ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুঁই হয়ে ঢুকে, কামান হয়ে বের হন। ২০২১ সালে বাবার মৃতুর সময় ‘রাজাকারের সন্তান’ পরিচয়টি ফাঁস হয়ে গেলে, ফরহাদকে দ্রুত রাজনীতি থেকে সরিয়ে সরকারি অর্থায়নে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের’ জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি ধামাচাপা পরে গেলে ২০২২ সালে দেশে ফিরে তিনি আবার আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা সেল-এ সক্রিয় হন।
ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ বিভিন্ন সময় কূটনীতিকদের উদ্ধৃতিকে নিজের মনগড়া অপব্যাখ্যা দিয়ে স্যোশাল মিডিয়া, টিভি ও অনলাইন টক শোতে উপস্থাপন করতেন। মাঝে মাঝে এমন তথ্যও তুলে ধরতেন যা শেখ হাসিনার বিশ্বাসের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হতো। এছাড়াও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের নেতৃত্বে একটি বিশেষ মিডিয়া সমন্বয়ক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী সাবেক মেয়র আতিকের সাথে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে কর্মরত ছিলেন।
ক্ষমতার শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে দ্রুত সম্পর্ক উন্নয়নে পটু ফরহাদ-তন্ময় জুটির বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী নেতাকর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ উঠে এসেছে। এছাড়া ধানমন্ডির ৬/এ এলাকায় আলাদা অফিস গড়ে তুলে সিআরআইয়ের নাম ভাঙিয়ে গত সংসদ নির্বাচনের সময় নমিনেশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
তন্ময় আহমেদ একসময় ছাত্রশিবিরের তথ্য বিভাগে কাজ করতেন। তিনি স্কুলে পড়াশোনাকালীন সময়ে স্থানীয় জামায়াত ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বুয়েটের ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সিআরআইয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। এরপর অল্পদিনেই সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সিআরআইয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নসরুল হামিদ বিপুর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ফুলেফেঁপে উঠেন। ২০২৩ সালে নসরুল হামিদ বিপু তাকে তিতাস গ্যাস কোম্পানির পরিচালকের পদে বসিয়েছিলেন।
২০২২ সালে ‘মিথ্যা খবর ও বানোয়াট তথ্য’ ছড়ানোর অভিযোগে জার্মানি-ভিত্তিক দ্য কনর্যা ড আডেনাওয়া স্কুল ফর ইয়াং পলিটিশিয়ান (কেসিপ) নামে একটি আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ প্রোগ্রাম থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
তন্ময় সিআরআই মিডিয়া-উইংয়ের প্রধান হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিআরআইয়ের সমন্বয় করার কাজটি করতেন। সিআরআইয়ের কাজে অর্থায়ন করা ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী, এমপি-মন্ত্রীদেরও সমন্বয় করতেন তিনি। তন্ময়ের নেতৃত্বে লাখ লাখ টাকা বেতনে কাজ করতো বিদেশে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একঝাঁক ডিজিটাল এক্সপার্ট। এরাই সমন্বয় করতো স্থানীয়দের সঙ্গে।
এক সূত্র বলেছে, তন্ময়ের উদ্যোগে সিআরআই থেকে দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের মাসিক বেতন ও ভাতা প্রদান করা হতো। তন্ময়ের নেতৃত্বাধীন মিডিয়া সেল মিডিয়া হাউজগুলোকে যা লিখতে বলত, তারা তাই লিখতে বাধ্য হতো। এছাড়াও তন্ময়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিডিয়া মালিকদের সাথে প্রকাশ্যে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।
এক অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, হাসিনা সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ ব্যাংককে এবং তন্ময় আহমেদ কলকাতায় লুকিয়ে রয়েছেন। মূলত, সিআরআইয়ের পরিচালনা পর্ষদ বিভিন্ন রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপব্যবহার করেছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সিআরআইয়ের নামে আইএফআইসি ব্যাংকে ৩৫ কোটি ২১ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট (এফডিআর) পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়াও সোনালী ব্যাংকে লেনদেনের রেকর্ডও পাওয়া গেছে।