দীর্ঘ প্রায় এক দশক পর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) শাখার নতুন কমিটির অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। তবে কমিটি গঠনের পর পরই কমিটির অনেককে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। অভিযোগ রয়েছে, নতুন এই কমিটিতে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরোধিতাকারী, শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেকেই ছাত্রদলের কমিটিতে রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ মার্চ রাতে দীর্ঘদিন পর কমিটির অনুমোদন দেয় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সংসদ। ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটিতে একজন সিনিয়র সহ-সভাপতি, ১০ জন সহ-সভাপতি, একজন সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ১৭ জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ১২ জন সহ-সাধারণ সম্পাদক, একজন সাংগঠনিক সম্পাদক, ১০ জন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও ২২ জন বিভিন্ন সম্পাদক পদে রয়েছেন। কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের রাহাত জামান ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের নাঈম সরকার।
নতুন কমিটি হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নানা-আলোচনা সমালোচনা। কমিটিতে অন্তত ১০ জনের মত নেতা পূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতি ও নেতার অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন কমিটিতে ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন মো. মোবিন সিদ্দিক। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম সীমান্তের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিলেন।জুলাই বিপ্লব চলাকালীন আজিজুল ইসলাম সীমান্তের সঙ্গে তার ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের একটি কথোপকথন ভাইরাল হয়েছে। যেখানে আজিজুল ইসলাম সীমান্ত লিখেন ‘Yesterday we made a remarkable comeback। কোটা আন্দোলনকারীদের ভরে দেওয়া (নির্যাতন অর্থে) হবে।’ এ সময় মুবিন সিদ্দিক লিখেন, ‘ইনশাল্লাহ ভাই আমাদের অনেকে গেইটে ও সুরমায় আছি আপনি সিলেট থাকলে আরো মজা হতো।’’ বিষয়টি অস্বীকার করে মুবিন সিদ্দিক বলেন, ‘এটি একটি এডিটেড (সম্পাদিত) স্ক্রিনশট।’
ছাত্রদলের একই কমিটিতে সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন রাহাত হাসান হৃদয়। গত ২০২৩ সালের ১১মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আবাসিক হল থেকে ৮ জন ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এই তালিকায় রাহাত হাসান হৃদয় ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন শাহ-এর অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসের পরিচিত ছিলেন।
জানতে চাইলে রাহাত হাসান হৃদয় বলেন, ‘আমি হল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর হল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছাত্রলীগের সঙ্গে আমি থাকতাম শুধু হলের সিটের জন্য। মনে প্রাণে কখনই ছাত্রলীগকে ধারণ করিনি। জুলাই আন্দোলনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনার বিপক্ষে প্রচার প্রচারণা করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
শাবিপ্রবি ছাত্রদলের নতুন কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক নুর আলম রাজিব। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ছাত্রলীগ নেতা মেহেদি হাসান স্বাধীনের অনুসারী ছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, সেই বলয়কে কাজে লাগিয়ে ভর্তি না হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরাণ হলের ২১৪ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। জুলাই আন্দোলন চলাকালীন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দ্বারা হলে অভিযানকালে সেই রুম থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নুর আলম রাজীব বলেন, ‘ওই কক্ষে সিনিয়র একজন থাকত। ওনি চলে গেলে এটা গেস্ট রুম ছিল।’
ছাত্রদলের নতুন কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ তিনি জাতীয় ছাত্রদলের (বামপন্থী ছাত্রসংগঠন) রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, তিনি বর্তমানে জাতীয় ছাত্রদল শাবিপ্রবি শাখার পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক।
এ বিষয়ে জাতীয় ছাত্রদল শাবিপ্রবি শাখার সভাপতি ওয়াসিম মাহমুদ শামস বলেন, সে ছাত্রদলে নতুন পদ পেয়েছে। এটা জানার পর আমরা তাকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য বলেছি। সে এখনো আমাদের কাছে ইস্তফা দেওয়ার চিঠি পাঠায়নি। এ বিষয়ে জানতে খালিদ সাইফুল্লাকে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করতে চাইলেও পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ছাত্রদলের নতুন এই কমিটিতে স্থান পাওয়া অনেকের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। নতুন কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. জুনায়েদ হাসান, সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. শরীফ মিয়া, অর্থ সম্পাদক তারেক রহমান, মানবাধিকার সম্পাদক আছিফ মাহবুব ওহী তারা সকলেই পূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান চাঁদ, মোহাম্মদ সোহানুর রহমান ও গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মুনতাসির মামুন শুভ পূর্বে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তাদের অনেকেই ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন বলে জানা গেছে।
ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকাদের পরে ছাত্রদলের বিভিন্ন পদ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সহ-সভাপতি ও ছাত্রদল সিলেট অঞ্চলের তত্ত্ববধায়ক ওলিউজ্জামান সোহেল বলেন, ‘সিলেটের অনেককেই আমরা চিনিনা। দুই তিন মাস দায়িত্ব নেওয়ার পর যাচাই বাছাই করে কমিটি দিতে পেরেছি। তবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই বাছাই করার পর্যাপ্ত সময় আমাদের হাতে ছিল না। তবে সক্রিয় ছাত্রলীগকর্মীর কেউ যদি থাকে, হয়তোবা কেউ থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে আমরা তদন্তসাপেক্ষে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিব।’
এ বিষয়ে জানতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও বন্ধ পাওয়া যায়।