ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা যেন নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানে সাভারের ব্যাংক টাউন ব্রিজ এবং সিএন্ডবি এলাকায় দুইটি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, ডাকাতরা আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে যাত্রীবেশে বাসে উঠে এবং অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়। একটার পর একটা ঘটনার পরও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তবে পুলিশ বলছে, তারা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছে এবং নিয়মিত টহল বৃদ্ধি করেছে। সাভার মডেল থানার ওসি জুয়েল মিঞা বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত করছি, সন্দেহভাজনদের নজরদারিতে রেখেছি।’
গতকাল প্রথম ঘটনাটি ঘটে দুপুর ১২টার দিকে। গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে রাজধানীর গাবতলীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ‘সাভার পরিবহন’ নামের একটি বাস যখন সাভারের ব্যাংক টাউন স্ট্যান্ডে আসে তখন তিন জন যুবক যাত্রীবেশে বাসে উঠে। ব্যাংক টাউন ব্রিজের ওপর পৌঁছলে তারা আচমকা কোমর থেকে ধারালো দেশীয় অস্ত্র বের করে যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলে। শুরু হয় যাত্রীদের আর্তনাদ। নারীদের কানে থাকা দুল, গলায় থাকা সোনার চেইন, মোবাইল ফোন, নগদ টাকা সব লুটে নেয় তারা। একপর্যায়ে এক নারী যাত্রীর গলায় ধারালো ছুরি ঠেকিয়ে বলে, ‘চেইন খোল, না হলে গলা কেটে ফেলব।’ আতঙ্কিত যাত্রীদের কেউ কেউ চোখ বুজে বসে থাকেন, কেউ বা কাঁদতে থাকেন। পরে বাসটি রাজধানীর গাবতলীতে পৌঁছলে যাত্রীরা বাসের চালক ও সহকারী আটক করে দারুসসালাম থানায় সোপর্দ করে।
ঘটনার পরপরই, মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সিএন্ডবি এলাকায় ‘রাজধানী পরিবহন’ নামের আরেকটি বাসেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। বাসটি ঢাকা থেকে নবীনগরের দিকে যাচ্ছিল। এখানেও একই কায়দায় যাত্রীবেশী ডাকাতদল দেশীয় অস্ত্র বের করে যাত্রীদের জিম্মি করে মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়।
সাভার পরিবহনের প্রত্যক্ষদর্শী বাসযাত্রী তায়েফুর রহমান জানান, আমি সাভার পরিবহনের একটি বাসে করে পরিবার নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। বাসটি ব্যাংক টাউন বাসস্ট্যান্ডে থামানো হলে তিন জন যুবক গাড়িতে উঠে। পরে গাড়িটি ব্যাংকটাউন ব্রিজের ওপর পৌঁছালে মহিলা যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের সাথে থাকা মোবাইল ফোন, গলার চেইন, কানের দুলসহ স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে নেমে যায়।
এখানেই শেষ নয়। এই দুইটি ঘটনার মাত্র সাত দিন আগে গত ৪ এপ্রিল ঠিক একই এলাকায় ‘ইতিহাস পরিবহন’ নামের আরেকটি বাসে একই ধরনের ডাকাতি হয়। ঐ বাসে ডাকাতির শিকার টুনি নামে এক নারী যাত্রী জানান, বাসে উঠার কিছুক্ষণ পর দেখি, চালক-হেলপার হঠাত্ বাস থামিয়ে দিল। তারপর কয়েক জন যুবক বাসে উঠে এসে আমার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে চেইন খুলে নেয়। তাদের একজন চালকের সঙ্গে সিগন্যাল দিচ্ছিল। মনে হলো, ওরা সবাই এক টিম। এই ঘটনায় যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে চালক রজব আলী ও হেলপার এমদাদুল হককে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু এরপরও ডাকাতির ঘটনা বন্ধ হয়নি।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একের পর এক বাস ডাকাতি সংঘটিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ঘটনারই কার্যকর সমাধান হয়নি। এর আগে ২ মার্চ ও ২৬ মার্চ একই এলাকায় দুইটি পৃথক বাসে একই ধরনের ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত ২৪ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেইট এলাকায় বাস ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল। প্রতিটি ঘটনায় বাসযাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেওয়া হয়। যদিও কয়েকটি ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, কিন্তু পুলিশ কোনো ডাকাতকে আটক বা লুট হওয়া মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি। এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ব্যাংক টাউনের অদূরে পুলিশ টাউন এলাকার সেতুর কাছে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা শুভযাত্রা পরিবহনের একটি বাসেও এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
এই রুটে নিয়মিত চলাচলকারী একাধিক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, এই রুটে গত তিন মাসে অন্তত সাত/আটটি চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একটি ঘটনারও সঠিক তদন্ত হয়নি, ধরা পড়েনি হোতারা।
এ ঘটনায় সাভার মডেল থানার ওসি জুয়েল মিঞা বলেন, এটা ডাকাতি না ছিনতাইয়ের ঘটনা। পাঁচ জনের অধিক হলে ডাকাতি এবং পাঁচ জনের কম হলে ছিনতাই হয়। এ বিষয় দুর্বৃত্তকবলিত বাসযাত্রী তায়েফুর রহমান বলেন, ‘আমরা ছিনতাই বা ডাকাতি বুঝি না। মহাসড়কে দিনের বেলায়ও যাত্রীরা নিরাপদ না—এটাই বড় কথা।’
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহীনুর কবির জানান, ছিনতাইকারীদের ধরতে আমাদের সার্বক্ষণিক টহল টিম রয়েছে। সাদা পোশাকেও পুলিশ এই চক্রটিকে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।