দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ক্যান্সার চিকিৎসা পাওয়া দুস্প্রাপ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বিকল। গতকাল শুক্রবার বন্ধের দিনেও মহাখালী ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় আবদুর রহিম নামের একজন রোগী বসে আছেন। তার বাড়ি নেত্রকোনা পূর্বধলায়। তিনি ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত। গত দুই মাস ধরে চেষ্টা করেও ভর্তি হতে পারছেন না। তাকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগে। সেখানে গিয়ে দেখেন রেডিও থেরাপি মেশিন ১১ মাস ধরে বন্ধ। মহাখালী ক্যান্সার ইনস্টিটিউট থেকে বলা হয়েছিল, ওখান থেকে রেডিও থেরাপি দিয়ে এলে এখানে চিকিৎসা শুরু করবো।
রহিমের মতো শত শত ক্যান্সার রোগী সরকারি হাসপাতালে ভর্তির আশায় প্রতিদিন ঘুরছেন। বেসরকারিভাবে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা দরিদ্র রোগীদের বহন করা সম্ভব নয়। এমনকি স্বচ্ছল রোগীরাও বেসরকারি হাসপাতালে কয়েক মাস চিকিৎসা নেয়ার পর এক পর্যায়ে তাদের পক্ষেও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
ক্যান্সার রোগীদের দুরবস্থা ও হয়রানি সম্পর্কে সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, মেশিন মেরামত করার জন্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে অনেকবার চিঠি দেয়া হলেও দায়িত্বশীলরা কর্ণপাত করেন না।
সরেজমিনে গিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মহাখালী ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার ও রোগীদের সঙ্গে আলাপ করেন ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি। সেখানে ক্যান্সার রোগীদের চরম হয়রানি, মাসের পর মাস অপেক্ষার পরও ভর্তি হতে না পারার অভিযোগ পাওয়া যায়। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা এর সত্যতা অকপটে স্বীকার করেছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ক্যান্সার ধরা পড়ার পর রোগীকে সময়মতো ও নিয়মিত চিকিৎসা দিলে বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর চিকিৎসা সেবা নিয়মতান্ত্রিকভাবে শুরু হয়। এই ব্যবস্থায় বিলম্ব কিংবা সময়মতো না পেলে রোগীর জটিলতা বেড়ে যায় এবং মৃত্যুর ঝুকি তৈরী হয়। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৮০ ভাগের চিকিৎসা রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপির উপর নির্ভরশীল। অনেকের অপারেশনেরও প্রয়োজন হয়। যত দ্রুত অপারেশন বা চিকিৎসা হবে তত মঙ্গল । কিন্তু সরকারি পর্যায়ে যে অব্যবস্থাপনা তা রোগীর মৃত্যু আরো ত্বরান্বিত হয়। তারা বলছেন, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি থাকা জরুরি। এই কমিটি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এবং রোগীদের চিকিৎসা সেবার সমস্ত গাইডলাইন তৈরি করবে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যন্ত এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু থাকা উচিত। যাতে করে রোগীরা ধাপে ধাপে চিকিৎসা পেতে পারেন। কিন্তু ক্যান্সারের চিকিৎসা ঢাকা কেন্দ্রীক। রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, সার্জারি, চেমোথেরাপি, হরমোনাল, টার্গেটেড থেরাপি ও ইমোনথেরাপি পদ্ধতিতে ক্যান্সারের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার এন্ড জেনারেল হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডাঃ এএমএম শরীফুল আলম বলেন, দেশে ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা অনেক। চাহিদার তুলনায় সরকারিভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা খুবই সীমিত। আর রোগীর চাপে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা পাওয়া কঠিন। রেডিওথেরাপি শুরু করলে যে নিয়মে ডাক্তার বলবেন সেই নিয়মে চললে রোগী সুস্থ হতে থাকবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রোগীর চাপের কারণে সেই নিয়ম মানা সম্ভব হয় না। সরকারি পর্যায়ে মেশিন নষ্ট। রোগী সময়মতো রেডিওথেরাপি দিতে পারেনা। এ কারণে দ্রুত সুস্থতার চেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে পরে অপারেশন করেও লাভ হয় না।
দেশে সর্বপ্রথম ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এই হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগের কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে রেডিও থেরাপির কোভাল্ট মেশিন ১১ মাস ধরে নষ্ট। এখানে আগত রোগীদের ৮৫ ভাগই দরিদ্র। তারা এখানকার চিকিৎসা সেবার উপর নির্ভরশীল । হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই মেশিন সচল করার জন্য অনেক চেষ্টা তদ্বির করেছে। যে কোম্পানি বাংলাদেশে মেশিনটা সাপ্লাই করেছে, সেই কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেছে। ওই কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধির সাথেও যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু টাকার অভাবে সচল করা যায়নি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে যোগযোগ করেছি। আশা করি দ্রুত সচল করতে পারবো।
মহাখালীর ৫০০ বেডের ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সারাদেশ থেকে রোগী আসছে। ২০ জন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক মাস/দুই মাস অপেক্ষায় থেকেও ভর্তি হতে পারছেন না। ডাক্তার বলেছেন, জরুরি রেডিওথেরাপি দিতে। কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেন, ক্যান্সার রোগীদের জীবন রক্ষার্থে জরুরি ভিত্তিতে কোটেশনের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা করা প্রয়োজন। এই কমিটি চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ ও কেনাকাটা করবে। উপজেলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত দেখভাল করবে। তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে তা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করবে। সেই ধরনের ব্যবস্থা করলে রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাবে। এই হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, লিনিয়ার এক্সেলেটর দুটি মেশিন দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। আপাতত আমার দরকার ৭টা মেশিন। দুটি মেশিনের মধ্যে একটা চালু আছে। চিকিৎসকরা এই ব্যবস্থার মধ্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এখনো ৫/৬টা মেশিন বসানোর জায়গা আছে। চাপ সামাল দিতে ডাক্তার-নার্সরা হিমশিম খাচ্ছে।
অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, এই দেশে ক্যান্সার রোগীর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। প্রতি বছর ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। মারা যায় ১ লাখ ১৬ হাজার। বেশিরভাগই সুচিকিৎসার অভাবে মারা যায়। তার মতে, ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডাইরেক্টর অধ্যাপক ডা. জয়নাল আবেদনি টিটু বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থাটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমরা কর্মপন্থা প্রস্তুত করছি। ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বাহিরে মুগদা মেড্যািকাল কলে হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং ঢাকা বাহিরেও বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত আমরা যেখানে প্রয়োজন, সেখানে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থাটাকে সম্প্রচারণের ব্যবস্থা নিয়েছি। দ্রুত যাতে তা বাস্তবায়ন করা যায় সেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।