মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

নিয়ম মানছে না লক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেন, বইয়ের চাপে বিবর্ণ শৈশব

আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০০

দেশে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাজধানীসহ সারা দেশে পাড়া-মহল্লার অলিগলি, ফ্ল্যাট বাড়ি বা ছাদে ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে উঠেছে লক্ষাধিক বেসরকারি প্রাক-প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল। এরমধ্যে প্রায় ৪০০ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অনুমোদন পেলেও বাকিগুলো অনুমোদনহীন। প্রায় ২ কোটি শিশু পড়াশুনা করছে এসব প্রতিষ্ঠানে। অনভিজ্ঞ শিক্ষক, সঠিক সিলেবাসের অভাব এবং উপযুক্ত গাইডলাইন না থাকায় মানসম্মত শিক্ষার ছিটেফোঁটা পাচ্ছে না তারা। অথচ ইচ্ছেমতো ভর্তি ফি, টিউশন ফি ছাড়াও বিভিন্ন পরীক্ষার নামে ফি আদায় করা হচ্ছে। 

পাশাপাশি নোট-গাইড ফি দিতেও বাধ্য করা হচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ছোট পরিসরে শুরু করলেও এখন স্কুল অ্যান্ড কলেজ নাম দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনে এসব কিন্ডারগার্টেনের অনুমোদন না থাকলেও অন্য স্কুলের নামে তারা রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিজেদের শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় বসাচ্ছে। বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি এসব কিন্ডারগার্টেনের কোনো কোনোটি ইংরেজি মাধ্যমও চালু করেছে। সেখানে প্লে-গ্রুপ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। অথচ অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানেরই সর্বোচ্চ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর কথা। এসব প্রতিষ্ঠান পাড়া-মহল্লায় চটকদার ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আসছে। এসব বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে অভিভাবকরাও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তুলে দিচ্ছেন কিন্ডারগার্টেনগুলোর সংশ্লিষ্টদের হাতে। অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি ও সংকীর্ণ পরিবেশে চলছে ক্লাস-পরীক্ষা। একটি কক্ষ বা একটি খুপরি ঘরই যেন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শরীরচর্চার আলাদা জায়গা নেই; জাতীয় সংগীত এবং শপথ পাঠ হয় শ্রেণিকক্ষেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষকও। যারা এসব কিন্ডারগার্টেনে পাঠদান করাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই আবার কলেজপড়ুয়া। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা বলে দিনের পর দিন তাদের দিয়েই চলছে ক্লাস-পরীক্ষা।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, ভুঁইফোঁড় এসব স্কুলে ভর্তি হয়ে কোমলমতি শিশুরা শিক্ষাজীবনের শুরুতেই যথাযথ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে উচ্চস্তরে গিয়ে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। নার্সারি ও কেজির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের পাশাপাশি প্রায় এক ডজন বই পড়তে হয়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে-গ্রুপে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কোনো বই না থাকলেও এ স্তরের শিশুদের বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি ব্যাকরণ, জ্যামিতি, অ্যাকটিভ ইংলিশ, ধর্ম, সাধারণ জ্ঞান, পরিবেশ পরিচিতি, ওয়ার্ড বুক, ড্রয়িং বুকসহ ১৪টি ডায়েরি কিনতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তী ক্লাস নার্সারিতেও ১২টি বই ও ১৫টি ডায়েরি, কেজিতে এনসিটিবির তিনটি বইসহ ১২টি বই পড়ানো হচ্ছে। এভাবে প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অতিরিক্ত বই পড়ানো হয়। আছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কিন্ডারগার্টেনের এসব শিক্ষার্থীর একদিকে যেমন মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অতিরিক্ত বইয়ের চাপে বিবর্ণ হচ্ছে শৈশব। দেশের শিক্ষাবিদরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, দ্রুত এ-সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন না হলে কিন্ডারগার্টেনের নামে লাগামহীন ‘শিক্ষাবাণিজ্য’ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। এমন অবস্থায় যত্রতত্র গড়ে তোলা প্রাক-প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সব স্কুলকে এক ছাতার নিচে আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এসব স্কুলের প্রাথমিক অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করতে আগের নীতিমালা কিছুটা সংশোধন আনতে একটি সাব-কমিটি করা হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলকে নিবন্ধন ও শিক্ষাবিষয়ক (একাডেমিক) স্বীকৃতির আওতায় আনতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে গঠন করা হচ্ছে স্বতন্ত্র অধিদপ্তর। সর্বশেষ গত ১৯ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানার সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় পৃথক এই অধিদপ্তর গঠনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরই কার্যক্রম শুরু করবে নবগঠিত এই অধিদপ্তর।’ 

জানা গেছে, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। অন্যগুলো কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি বিদ্যালয়। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশের নিবন্ধন নেই। ইচ্ছেমতো তারা চলছে। আগে একটি বিধিমালা থাকলেও সেটি বাস্তবে কাজে আসেনি। এখন সেটিকে আরও যুগোপযোগী করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর উত্তর শ্যামলীর ১৮৬ ভূঁইয়া গলিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘কর্ডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। চারতলা একটি আবাসিক ভবনের নিচতলা ভাড়া নিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। অন্ধকারাচ্ছন্ন চারটি কক্ষে চলে ক্লাস-পরীক্ষা। বাংলা ও ইংরেজি, দুই মাধ্যমই চালু রয়েছে এখানে। সারা বছরই শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। মোট শিক্ষার্থী তিন শতাধিক। তবে শিক্ষক মাত্র সাত জন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী। শ্রেণিকক্ষ ছোট হওয়ায় শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে বসতে হয়। ইচ্ছেমতো ভর্তি ফি, টিউশন ফি নির্ধারণ করে কর্তৃপক্ষ। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বাইরেও তিন থেকে পাঁচটি বই অতিরিক্ত পড়ানো হয়। সেজন্য বাড়তি ফিও আদায় করা হয়। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেও স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি, কোনো শিক্ষকই মিডিয়ায় কথা বলতে চাননি। একই অবস্থা বিরাজ করছে মিরপুর-১১ নম্বরের ১৪ নম্বর সড়কে ‘মীরপুর ইম্পীরিয়্যাল স্কুল’। লোভনীয় অফারে সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। প্লে-গ্রুপ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত চালু রয়েছে সেখানে। স্কুলটিতে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে স্কুলটির কোনো অনুমোদন নেই। শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন আশপাশের কয়েক জন নারী এবং এইচএসসি ও অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছর জুড়ে এখানে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। ইচ্ছেমতো নিজেরাই তৈরি করেন সিলেবাস। ফিও নির্ধারিত নয়। যার থেকে যেমন খুশি অর্থ আদায় করা হয়। তবে প্রাথমিকে সর্বনিম্ন ৮০০ টাকা এবং মাধ্যমিকে ১ হাজার ৪০০ টাকা টিউশন ফি আদায় করা হয়ে থাকে। খেলাধুলার জায়গা না থাকলেও ফি রয়েছে। এছাড়া আইডি কার্ড, সেশন চার্জ, নোট-গাইড ফি আদায় করা হয়। ‘মীরপুর ইম্পীরিয়্যাল স্কুল’র অনুমোদন না থাকায় জেএসসি ও এসএসসি শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করানো হয় এমপিওভুক্ত ‘মিরপুর আদর্শ বিদ্যা নিকেতনে’। ঢাকার রামপুরার উলন রোডে এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা মিলে ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ১০টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় কয়েক শ কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে, যাদের কোনো অনুমোদন নেই। সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরের মধ্যে নিবন্ধন ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে প্রায় ৫০০ কিন্ডারগার্টেন। 

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক জন কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী ভাড়া কিংবা স্থায়ী ভবনে হোক, মহানগর এলাকায় ন্যূনতম ৮ শতক, পৌরসভায় ১২ শতক এবং অন্য এলাকায় ৩০ শতক জমিতে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় হতে হবে। এছাড়া শিক্ষকদের পৃথক রুম, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি ও সুপেয় পানির সুব্যবস্থাসহ ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অধিকাংশ স্কুল এসব নিয়ম না মেনেই গড়ে উঠেছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক জন অধ্যাপক বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেনে যে মানের শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন, তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন উঠেছে। তারা না বুঝেই বাচ্চাদের অতিরিক্ত চাপ দেন। মুখস্থ বিদ্যার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ক্লাসে যখন তারা বাচ্চাদের পড়ান, পাঠ্যবই রিডিং পড়ানোই যেন তাদের একমাত্র কাজ। হাতেকলমে শেখানোর বিষয়গুলোও তারা লাইন বাই লাইন মুখস্থ করান। ক্লাসে নিরানন্দ পরিবেশে তারা পড়িয়ে থাকেন।’ 

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের এক জন কর্মকর্তা বলেন, কিন্ডারগার্টেন মূলত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য। অথচ সেখানে অবৈধভাবে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। সরকারি নজরদারি না থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক জন কর্মকর্তা গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, এনসিটিবি আইন-২০১৮ অনুযায়ী বাংলাদেশে পরিচালিত সব স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রম এনসিটিবির নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হবে। একই সঙ্গে যারা বিদেশি কারিকুলামে পাঠদান করছেন তাদেরও এনসিটিবির অনুমোদন নিতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কোনো কিন্ডারগার্টেন স্কুলই এ নিয়ম মানছে না।

ইত্তেফাক/এমএএম