শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

নতুন রোহিঙ্গাদের শেল্টার নির্মাণে ফুঁসে উঠছে স্থানীয়রা

আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ২০:৫৮

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা কৌশলে নতুন করে দেশে আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। ওই দালালদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অফিস সূত্রে জানা যায়, নতুন করে পালিয়ে আসা লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে উখিয়ার ১৪নং আশ্রয়শিবিরে ‘সাওয়াব’ নামের একটি এনজিও ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন।

রোহিঙ্গা আগমনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিদিনই কোন না কোন অভিযোগ নিয়ে আসেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে। এরই মধ্যে লিখিত অভিযোগ করেছে নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঘর নির্মাণের বিষয়ে।

স্থানীয়রা বলছেন, সরকার যেখানে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে- ঠিক সেই সময়ে প্রত্যাবাসন কার্যক্রমে বাধাগ্রস্ত করতে অতি উৎসাহী হয়ে নতুন রোহিঙ্গাদের জন্য শেড তৈরি করে দিচ্ছে একটি এনজিও।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, ১৪ নং আশ্রয়শিবিরের কাঁটাতারের সাথে লাগোয়া ১২২ টির অধিক শেড নির্মাণ করা হয়েছে নতুন করে। যা ২০০৮ সালের সৃজিত বন বিভাগের সামাজিক বনায়নের জায়গা জলধার ছিল। উক্ত জলাধার ভরাট করে ঘর গুলো নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের কাজ করছে ‘সাওয়াব নামের একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)’। নতুন করে তৈরি রোহিঙ্গা রোহিঙ্গা পল্লীটির নাম দেওয়া হয়েছে আমেনা ভিলেজ।

স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ও সামাজিক বনায়নের অংশিদাররা জানিয়েছেন- “ঢালাওভাবে রোহিঙ্গা আগমনে আমাদের চরম ক্ষতি হয়েছে, জামি, বাগান, জলধারা, পুকুর সহ নানা ধরণের সম্পদ হারিয়ে অনেকটা দিশেহারা। হোস্ট কমিনিউনিটি লোকজনকে যতটুকু সম্ভব সরকার সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলে তা দেওয়া হয়নি।”

সামাজিক বনায়নের অংশীদার আবছার উদ্দিন বলেন, “গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় নতুন করে আবারও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিতে সচেতন মহল সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।”

জানা গেছে, গত কয়েক মাসে কৌশলে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ফের বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। তারা টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। ইউএনএইচসিআরের খাতায় তাদের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। তারা ত্রাণ সামগ্রীও পাচ্ছে। কিন্তু সরকারের রেজিস্ট্রারে তাদের উদ্বাস্তু হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ওই রোহিঙ্গাদের দেড়শ' পরিবারের জন্য “সাওয়াব নামে এনজিওটি” প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যায়ে শেড তৈরি করে চলেছে।

এনজিওটির বিরুদ্ধে “সামাজিক বনায়নের হাজার হাজার গাছকর্তন ও জলধারা ভরাট করে নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ঘর তৈরির অভিযোগ উঠেছে। 

সংস্থাটির বিরুদ্ধে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় বনকর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত উপকারভোগীরা লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগকারীরা জানান, ২০০৮ সাল থেকে বনবিভাগের সাথে চুক্তির মাধ্যমে সামাজিক বনায়ন করে আসছে। বনায়নের উপকার ভোগীরা কোন ধরণের ক্ষতিপূরণ পান নি। অথচ নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের সরিয়ে আনতে শেড নির্মাণ করা উদ্বেগজনক।

এ ব্যাপারে ছওয়াব-এর জেনারেল ম্যানেজার লোকমান হোসাইন তালুকদার জানান, উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৪-তে পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে ৩২২টি পরিবার। গতবছর পাহাড় ধসে সেখানে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোর মধ্যে ১৫০ পরিবারের জন্য শেল্টার তৈরির কাজ করছে ছওয়াব। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এই প্রকল্প অনুমোদন করে। যা সরকার কর্তৃক ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগের অনেক আগের।

তিনি আরও জানান, এছাড়া নির্মানাধীন শেল্টারের জায়গাটিতে গাছ ছিল না। খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এটি আগে বন বিভাগের থাকলেও বর্তমানে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। কাঁটাতারের ভিতরের এই জায়গাটি রোহিঙ্গাদের জন্য যথাযথ অনুমোদন নিয়ে শেল্টার নির্মাণ করছে ছওয়াব। একইসঙ্গে পাশের আরেকটি জমিতে রোহিঙ্গাদের খেলার জন্য জায়গা করে দেওয়া হয়েছে।

উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহিনুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, “বিষয়টি নিয়ে বনবিভাগ অবগত রয়েছে। জায়গাটি বনবিভাগ ও সামাজিক বনায়নের হলেও এখন যেহেতু কাঁটাতারের ভেতরের অংশ হয়ে গেছে তা নিয়ে বনবিভাগের তেমন কিছু করার নেই। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ভালো বলতে পারবে।”

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন- “নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কিছু শেড নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণের কাজ পেয়েছে ‘সাওয়াব’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। তারা সকল ধরণের নিয়ম মেনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। যেহেতু কাঁটাতারের ভেতরে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দকৃত জমি তাই স্থানীয়দের সমস্যা হওয়ার কথা না।”

তিনি বলেন, “যদি বনায়নের গাছকর্তন ও জলধার ভরাট করা হয়ে তাকে তদন্তপূর্বক সংস্থাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। স্থানীয় বাংলাদেশিদের লিখত অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত রয়েছি।”

স্থানীয় রশিদ আহমদ সওদাগর দাবী করেন, গত ৮ বছরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার রোহিঙ্গাদের কোথায় রাখা হয়েছিল? অনেক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ায় খালী হওয়া শেডগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এখনো। সেখানে স্থান না দিয়ে নতুন রোহিঙ্গাদের জন্য শেড তৈরির কী খুব দরকার ছিল? ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নাম দিয়ে এনজিও ব্যুরো থেকে অনুমোদন এনে ‘সাওয়াব’ নামের ওই এনজিও নতুন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে এসব শেড নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ তার।”

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চেয়ারম্যান বলেন, “আমরাতো সবাই মিলে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। রোহিঙ্গারা যখন এপারে পালিয়ে এসেছিল, তখন আমরা ঘর থেকে খাবার এনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এটা কি তার বদলা? 

একটি চক্রের সদস্যরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকারকে বঞ্চিত করে ক্যাম্প ১৪ হাকিমপাড়া সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষতি করে যাচ্ছে। যা উদ্বেগজনক ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একধরনের বাধাগ্রস্ত  বলে মনে করেন তিনি।”

তিনি বলেন- “স্থানীয় বাংলাদেশিদের জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির তৈরির কারণে বসতভিটা, চাষের জমি, মাছের পুকুর, ক্ষেতের ফসল, স্বপ্নের বাগান, সমস্ত আয়ের উৎস থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলে তা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক, দেশি ও স্থানীয় এনজিও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা আগমনের শুরু থেকেই নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে আসছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে। নতুন করে শেড ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করাও একটি ষড়যন্ত্রের অংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবী করেন সীমান্তের এ জনপ্রতিনিধি।”

ইত্তেফাক/এএইচপি