পহেলা বৈশাখ মানেই বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব। বৈশাখ বলতে আমরা গ্রামীণ লোকজ শিল্প আর সংস্কৃতিকে বুঝি। দিন দিন কালের বিবর্তন আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক লোকজ শিল্প আর সংস্কৃতি আজ হারানোর পথে। কিন্তু বৈশাখকে ঘিরে সেই হারানো শত বছরের ঐতিহ্য গ্রামীণ লোকজ শিল্প ও সংস্কৃতিকে কিছটুা হলেও বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেস্টা করা হয়। বর্তমান প্রজন্মরা জানতে পারে কেন পহেলা বৈশাখকে ঘটা করে উদযাপন করা হয়?
পহেলা বৈশাখকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বসে গ্রামীণ মেলা। যে মেলাগুলোতে দেশের হারিয়ে যাওয়া অনেক লোকজ গ্রামীণ শিল্প ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের যেগুলোতে গ্রামীণ লোকজ শিল্প ও সংস্কৃতিকে ফুটে তোলা হয়। প্রতিটি পহেলা বৈশাখেই নতুন প্রজন্মরা গ্রাম-বাংলার চিরায়িত শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ পায়।
আর এই সব আয়োজনের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মরা পালকী, লাঙ্গল-জোয়াল, মাছ ধরার খলিশানী, খেয়া জাল, ঘোড়া ও গরুর গাড়ী, হুক্কা, মাটির তৈরি শতবছরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্প, বাঁশ-বেতের শিল্প, গ্রামীণ লাঠিখেলা, হাডুডু খেলা, আলুর ভর্তাসহ বিভিন্ন ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়াসহ নানা লোকজ শিল্প আর সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারছে যেগুলো আজ অনেকটাই হারানোর পথে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম গ্রাম-বাংলার শত শত বছরের এই সকল গ্রামীণ লোকজ শিল্প ও সংস্কৃতিকে বহমান রাখতে হলে পহেলা বৈশাখের এই আয়োজনগুলোকে আরো বর্ধিত করার সঙ্গে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
সোমবার “মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা” বৈশাখের এই স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ কে বরণ করতে নওগাঁ জেলা প্রশাসন ও ১১টি উপজেলা প্রশাসন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এদিন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের নেতৃত্বে শহরের এটিম মাঠ থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়ে তা শহরের প্রধান প্রধান স্থান প্রদক্ষিণ শেষে পুরাতন ডিসি অফিসে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গনে দিনব্যাপী লোকজ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে সেখানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা বিজয়ীদের পুরস্কৃত করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল। এসময় জেলা প্রশাসন, সদর উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে রাণীনগর উপজেলা প্রশাসন দিনব্যাপী বর্ণিল কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচির প্রথমেই সোমবার সকালে উপজেলার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে গ্রামীণ লোকজ শিল্প আর সংস্কৃতিতে সজ্জিত একটি বর্ণাঢ্য বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা একই পাঞ্জাবী ও রঙ্গিন গামছা পরিহিত র্যালী শোভাযাত্রার সৌন্দর্য বর্ধন করে।
এছাড়া শোভাযাত্রায় রাণীনগর প্রেসক্লাব, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের র্যালীও অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রাটি উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গনে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে সমবায় অধিদপ্তরের আয়োজনে শতবছরের ঐতিহ্য মাটির পাত্রে আউশের চালের পান্তা ইলিশ গ্রহণ করা হয়।
এরপর মুক্ত মঞ্চে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় সংগীত পরিবেশন করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাদিরউজ্জামান জিনুক, প্রত্যাশা শিল্পীগোষ্ঠি, উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর নিয়মিত শিল্পীরা সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করে। পরে হারিয়ে যাওয়া গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় ঢোলের তালে তালে লাঠিয়ালদের নৃত্য আর লাঠির যাদুতে মুগ্ধ হয় শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধসহ সকল বয়সের মানুষ। দিনব্যাপী এমন বর্ণিল আয়োজন উপভোগ করতে এবং বর্তমান ও আগামী প্রজন্মদের সঙ্গে লোকজ শিল্প ও সংস্কৃতিকে পরিচয় করে দিতে স্ব-পরিবারে দর্শনার্থীরা উপস্থিত হয়ে উপজেলা পরিষদের অনুষ্ঠান প্রাঙ্গন মুখরিত করেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: রাকিবুল হাসান বলেন বর্তমান প্রজন্মরা শত বছরের গ্রামীণ অনেক ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিল্প আর সংস্কৃতিকে জানে না। একমাত্র পহেলা বৈশাখেই এমন গ্রামীণ লোকজ শিল্প আর সংস্কৃতিকে এক জায়গায় একত্রিত করার সুযোগ পাওয়া যায়। আর এই সুযোগে গ্রাম-বাংলার চিরায়িত শত বছরের ঐতিহ্যকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে নতুন করে তুলে ধরতেই মূলত পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এমন আয়োজন করা। এতে করে বর্তমান প্রজন্ম ও শহুরের শিশু থেকে সকল বয়সের মানুষরা গ্রাম-বাংলার লোকজ শিল্পের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়।