মিডিয়া দর্পণ স্বরূপ। এই দর্পণে সমাজের সংগতি-অসংগতি ভেসে উঠে, আলো-অন্ধকার ধরা পড়ে। প্রতিফলিত হয় মানুষের জীবনের বোধ, রুচিবোধ। তবে দর্পণে খাদ সৃষ্টি হলে যেমন অস্বচ্ছ প্রতিবিম্ব তৈরি হয় তেমনি মিডিয়া অপসংস্কৃতি বা অপব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকলে তার সৃষ্ট প্রতিফলন অসম্পন্ন রয়ে যায়। এই অসম্পূর্ণতা সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মনন ও দৃষ্টিভঙ্গিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট নির্মাতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। বিশেষ করে করোনা মহামারীতে লকডাউনের ঘরবন্দি জীবনে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহত পরিসরে ফেসবুক, ইউটিউব এমনকি ওটিটি প্লাটফর্মে কনটেন্ট নির্মাণ করে যাচ্ছেন অনেকে। একটি স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের সংযোগ থাকলেই ঘরে বসে বানিয়ে ফেলা যায় অডিও, ভিডিও বা এনিমেশন কনটেন্ট। এসব কনটেন্ট দর্শক মহলে চলছেও বটে। প্রাথমিক অবস্থায় এমন ব্যাপারকে স্বাগত জানাতে হয়। তবে একটু গভীরে গেলেই চিন্তার ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে নেটিজেনদের কপালে। ফেসবুক বা ইউটিউবে যেসব কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে তার অধিকাংশর-ই মান ও রুচি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার। বলে রাখা ভালো সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে কোনো মানদণ্ড দিয়ে যাচাই-বাছাই করা যুক্তিসংগত নয়। তবে সমাজ-সামাজিকতার বিচারে কিছু কিছু বিষয়কে একেবারে উপেক্ষা করাও যায় না বটে। এসব কনটেন্ট নির্মাতার অধিকাংশই স্কুল-কলেজগামী তরুণ-তরুণী। যাদের এখনো নিজস্ব বা স্বকীয় বোধ জেগে ওঠেনি। ফলে ইন্টারনেটের বদলাতে খুব সহজেই তারা জড়িয়ে পড়ছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে, যা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর প্রভাব এসে পড়ছে তাদের নির্মিত কনটেন্টে।
এসব কনটেন্টের কোনো নিবেদন নেই, সৃষ্টিশীলতা নেই, নান্দনিকতা নেই। তবে দর্শক প্রিয়তা আছে! এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে যে জিনিসের কোন সৌন্দর্য নেই, নির্মাণ শৈলী নেই তার জনপ্রিয়তা কেন? কারণটা হলো এত এত কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল ও সস্তা বিনোদন মূলক কনটেন্টের ভিড়ে ঠাই পাচ্ছে না ‘নান্দনিক’, ‘গঠনমূলক’ ও সৌন্দর্য ধারণকারী সৃষ্টিকর্ম। এমনকি টিভি, সিনেমাতেও পড়েছে এই প্রভাব। ফলে দর্শকদের মধ্যে গড়ে উঠছে না নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদেরকে যা-ই দেখানো হচ্ছে তাই গ্রহণ করছে দেদারসে। আরেকটি বড় কারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ও নিষিদ্ধ দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা বেশি। উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের কাছে এসব নেতিবাচক কনটেন্ট দারুণ আকর্ষণের বিষয়। তারা এসবের চর্চা করে যাচ্ছে প্রকাশ্যে এবং গোপনে। যা জাতীর ভবিষ্যতের জন্য শোচনীয়। তবে এসবের বিপরীতে যে একেবারেই নিবেদনমূলক ও নান্দনিক নির্মাণ শৈলী মেনে কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে না—এমনটা নয়, কিন্তু তা চাপা পড়ে থাকছে ওই সস্তা বিনোদনের তলাতেই।
ডিজিটাল যুগে তথ্য প্রবাহ যত সহজলভ্য হয়েছে, ততটাই জটিল হয়ে উঠেছে সত্য, মিথ্যা আর রুচির প্রশ্ন। এটাও খুব পরিস্কার যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা স্যোশাল মিডিয়া এখন কেবল বিনোদন বা ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়, এটি হয়ে উঠেছে নাগরিক চেতনা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র—একটি ডিজিটাল সিভিক স্পেস। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শুরু করে কোভিডকালীন সচেতনতামূলক প্রচারণা, এমনকি একটি সরকার পরিবর্তনের মতো আন্দোলনেও আমরা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখেছি।
রুচিশীল কনটেন্ট মানে শুধু শালীনতা বা ভাষার ভদ্রতা নয়—এখানে অন্তর্নিহিত থাকে যুক্তির স্পষ্টতা, মানবিকতা এবং সহনশীলতা। কিন্তু বর্তমানে আমরা এমন একটি ডিজিটাল সংস্কৃতির দিকে এগোচ্ছি, যেখানে ট্রেন্ডের দোহাই দিয়ে অশ্লীলতা, বর্ণবাদ, নারীবিদ্বেষ বা গুজবকে বিনোদন হিসেবে পরিবেশন করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে দরকার একটি সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথমত, রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে ডিজিটাল সিভিক স্পেসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা পাবে, কিন্তু সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার ঠেকানোর জন্য থাকবে কার্যকর আইন ও নীতিমালা। দ্বিতীয়ত, প্ল্যাটফর্মগুলোকে রেগুলেট করার নামে সেন্সরশিপ চাপানো যাবে না, বরং প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে রুচিশীলতা, ডিজিটাল লিটারেসি ও সমালোচনাশীল চিন্তার চর্চা গড়ে তুলতে হবে।
একটি সহজ সমীকরণ হলো বিশ্বায়নের এই যুগে বহি বিশ্বের কাছে একটি দেশের মানুষের রুচির মাত্রাকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি বা মিডিয়ার অন্যান্য নিয়ামক সমূহ যতটা-না তুলে ধরতে পারছে তার থেকে অধিকতর ফুটিয়ে তুলছে সেখানকার সাধারণ মানুষের নির্মিত স্যোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে থাকা এইসব কনটেন্ট গুলো। এই রিপ্রেজেন্টার মাধ্যম গুলোতেই যদি রুচির ঘাটতি থাকে যায় তবে প্রশ্ন উঠবে জাতীগত বোধ নিয়ে, নষ্ট হবে ভাবমূর্তি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।