রোববার, ২৫ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

৫ বছর ‘মুষ্টিচাল’ বিক্রির টাকা জমিয়ে এক কিলোমিটার রাস্তা বানালো গ্রামবাসী

আপডেট : ০৭ মে ২০২৫, ১১:৪৮

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মহড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম গবড়া। টাঙ্গাইলের তিন উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় এই গ্রামের অবস্থান হওয়ার কারণে যোগাযোগখাতে আলাদা গুরুত্ববহন করে এই ছোট গ্রামটি। কিন্তু প্রায় দুই যুগের অপেক্ষার পরও একটি রাস্তা নির্মাণ হয়নি সেখানে। সবশেষ পাঁচ বছর মুষ্টিচাল (এক মুঠো চাল) বিক্রির টাকায় জমিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা বানিয়েছে গ্রামবাসী।

স্থানীয় বাসিন্দা, গ্রামবাসী ও উপজেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, দেলদুয়ার ও বাসাইল এই তিন উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম গবড়া। গবড়া গ্রামের পাশেই রয়েছে ভাতকুড়া, ডুবাইল, মহেড়া ও স্বল্পমহেড়া গ্রাম। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এলাকাটি নিচু হওয়ায় এবং রাস্তা না থাকায় জেলা ও মূল উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ এই গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ঢাকা-রাজশাহী-খুলনা রেল লাইন। অবহেলিত গবড়ার পূর্বে নির্মাণ হয়েছে মহেড়া রেল স্টেশন। তবে চারপাশে এতো উন্নয়ন-অবকাঠামো নির্মাণ হলেও প্রায় দুই যুগ ধরে একটি সড়ক নির্মাণ হয়নি সেখানে। 

অথচ ভাতকুড়া, ডুবাইল, মহেড়া ও স্বল্পমহেড়া গ্রাম সংলগ্ন প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় কাঙ্ক্ষিত সড়কের অভাবে প্রতি বর্ষায় হাঁটু কাঁদা-পানি মাড়িয়ে চলাচল করে গ্রামবাসী। রাস্তা না থাকায় বয়স্ক, নারী, শিশুরা সারাবছরই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ২০১৯ সালে নিজেদের টাকায় সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামের ১৫০ পরিবার। তবে তাদের কাছে নগদ টাকা টাকায় পরিকল্পনা করা হয় প্রতি মাসে নিজেদের চাষ করা মুষ্টিচাল বিক্রির টাকা জমিয়ে নির্মিত হবে সড়ক।

যেই ভাবা সেই কাজ, এভাবে প্রায় পাঁচ বছর ধরে চাল বিক্রির টাকা জমাতে শুরু করেন গ্রামবাসী। সবশেষ সম্প্রতি সময়ে জমানো সেই চাল বিক্রির টাকায় প্রায় এক কিলোমটাজুড়ে মাটি ফেলে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করেন গ্রামবাসী।  এটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা, যেখানে আড়াই লাখ টাকা এসেছে পাঁচ বছরের জমানো মুষ্টিচাল বিক্রির টাকা থেকে। বাকি টাকা দিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন গণমান্য ব্যক্তি। 

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল হালিম বলেন, এই রাস্তাটির জন্য প্রায় দুই যুগ ধরে আমরা স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের নিকট আবেদন করেছি। ২০০১ সালের দিকে তৎকালীন চেয়ারম্যান এটি নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই যারাই এসেছেন সবাই আশ্বাস দিয়ে গেছেন। কিন্তু রাস্তা কেউ বানায়নি। পাঁচ বছরের মুষ্টিচালের টাকা জমিয়ে আমরা কাঁচা সড়কটি নির্মাণ করেছি। 

গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ওই গ্রামে দেড়শ পরিবার রয়েছে। মূলত তাদের মুষ্টিচালের টাকা বিক্রি করেই রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে। যাদের চাষের চাল নেই, তারা মাটি দিয়েছেন। রাস্তাটি নির্মাণের জন্য গ্রামবাসীর কেউ কেউ দিয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রম। মোট কথায় রাস্তাটি নির্মাণে কাঁধে কাঁধ মিলয়ে কাজ করেছে গ্রামের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কৃষক, দোকানিসহ পুরো গ্রামবাসী। তবে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ হওয়ার কারণে বর্ষায় সেটি চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাই সড়কটি পাকা করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

গ্রামের বাসিন্দা ও কলেজ ছাত্র সানান ও মিরাজ বলেন, পথটি অনেক নিচু ছিল। এখানে মাটি ফেলে আমরা প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা বানিয়েছি। কিন্তু বর্ষায় এখান থেকে মাটি সরে যেতে পারে। রাস্তাটি দ্রুত পাকাকরণে দাবি জানাচ্ছি। 

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুষ্টিরচালে নির্মিত হচ্ছে গ্রামের কাঁচা রাস্তা এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে। 

সবশেষ গত রোববার (৪ মে) মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম আরিফুল ইসলাম ও দেলদুয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাব্বির আহমেদ অবহেলিত গবড়া গ্রামের এই কাঁচা রাস্তা দেখতে আসেন।  এসময় সড়কটি পাকা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন তারা। এ সময় মির্জাপুর উপজেলা প্রকৌশলী মনিরুল সাজ রিজন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. কহিনুর রহমান, দেলদুয়ার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. রওশন করিম এবং মহেড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরকার বিভাস সরকার নুপুর উপস্থিত ছিলেন।

মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম আরিফুল ইসলাম ও দেলদুয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাব্বির আহমেদ বলেন, গবড়া গ্রামাটি ৩টি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায়। কিন্তু বিভিন্ন দিক দিয়ে অবহেলিত। বিগত দিনে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানও বিষয়টি প্রশাসনকে তেমনভাবে উপস্থাপন করেননি। গ্রামবাসী নিজেদের উদ্যোগে মুষ্টির চালে চলাচলের জন্য যে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করেছে এটা প্রশংসার দাবিদার। আমরা এলাকা ঘুরে দেখেছি, রাস্তাটি পাকা হওয়া খুব জরুরি। উপজেলা প্রকৌশলী অফিস ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত রাস্তাটি পাকা করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ইত্তেফাক/এপি