রোববার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

রকেট জলিলের মাথার মূল্য ছিল এক লক্ষ টাকা

আপডেট : ০৯ মে ২০২৫, ১৫:৫৮

চারদিকে শুনশান নীরবতা। মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। এরই মধ্যে পাকবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঝিকরগাছার শিমুলিয়া, মধুখালি এবং গঙ্গাধারপুর গ্রামের মেঠো অঞ্চল। লক্ষ্য মুক্তিবাহিনীদের ছত্রভঙ্গ করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী শিমুলিয়ার মাঠ দিয়ে একটি শক্ত পাক কমান্ডো বাহিনী গুলি করতে করতে সামনে এগোচ্ছে। বন্দুকের সামনে রেহাই পাচ্ছে না পশুপাখি পর্যন্ত। ঠিক এমন সময়ে কোথা থেকে এক তরুণ এসে রুখে দাঁড়ায় তাদের পথ। বয়স ২৬/২৭ বছর হবে। হাতে একটি এলএমজি গান। গানটি সামনের দিকে তাক করে একবার মাত্র ব্রাশ টানলো। এতেই পাখির মতো লুটিয়ে পড়ে প্রথম সারির সৈন্যরা। বাকিরা পালিয়ে যায়।  

অতর্কিত এমন হামলায় একেবারে দিশেহারা হয়ে যায় কমান্ডো বাহিনী। ঐদিন একই সময়ে আশেপাশের আরও দুই-তিনটি গ্রামে পাক বাহিনীদের ওপর হামলা চালানো হয় এবং সব কয়টি হামলার ধরন ছিল প্রায় একই রকম। এতে মারা পড়ে অনেক পাক সৈন্য। পরে জানা যায় সব কয়টি হামলাই চালিয়েছে রহস্যময় ওই তরুণ। 

তখন সবার মধ্যে চাঞ্চল্য—কে এই তরুণ, কী তার পরিচয়? অনেকে তাকে জ্বীন-ভূত বলেও আখ্যায়িত করে বসে। পরের দিন জানা গেলো এই তরুণ হলো পার্শ্ববর্তী পাল্লা গ্রামের এক ছেলে, নাম আব্দুল জলিল। জলিলের এমন দুঃসাহসিকতায় হতভম্ব এক পাকিস্তানী মেজর বলে উঠে—‘এয়া জলিল জ্বীন হে না রকেট হ্যে’। সেই থেকে আব্দুল জলিলের নাম হয়ে গেলো ‘রকেট জলিল’।

আব্দুল জলিল (রকেট জলিল)

১৯৪৩ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পাল্লা গ্রামে জন্ম নেন আব্দুল জলিল। পিতা মহর আলি ছিলেন একজন গ্রাম্য কৃষক। স্থানীয় স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে ১৯৬৩ সালে জলিল যোগ দেন মুজাহিদ কোম্পানিতে। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলে (ইপিআর) যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে জলিল কর্মসূত্রে রাজশাহীতে ছিলেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাকবাহিনী দখলদারি শুরু করলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ছুটে আসেন নিজ এলাকায়। নিজের ভাই, ভাতিজাসহ গ্রামের ৮-১০ জনকে নিয়ে গড়ে তুলেন একটি শক্ত ডিফেন্স বাহিনী। পাশাপাশি চাকরি থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শুরু করেন অস্ত্র প্রশিক্ষণের কার্যক্রম।

রকেট জলিল ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের একজন এম, এফ এবং বয়রা সাব সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে যশোর অঞ্চলে রকেট জলিল নামটি ছিল আতঙ্কের। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অথচ এই জলিলই একের পর এক অভিযানে কাবু করে ফেলে পাক বাহিনীদের। পাক কমান্ডোদের ধারণা ছিল ঝিকরগাছা ও শার্শা অঞ্চলকে পুরোপুরি দখলে নিতে গেলে আগে হত্যা করতে হবে পথের কাটা জলিলকে। এ লক্ষে তারা ‘জলিল নিধন’ মিশনে নামে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রহস্যময় জলিলকে খুঁজে পাওয়া। কখনো যদি শোনা যেতো জলিলের অবস্থান এখন যশোরে, পরক্ষণেই খবর আসতো জলিলকে দেখা গেছে বেনাপোল বর্ডারে! ফলে জলিলের সঠিক ঠিকানা বের করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জের।

একদিন জলিলকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাকবাহিনী হানা দেয় পাল্লা গ্রামে। তবে সেখানেও জলিলের দেখা মেলে না বা কেউ সন্ধান দিতে পারে না। জলিলকে না পেয়ে একপর্যায়ে তারা ওই অঞ্চলের জলিল নামের সকল লোককে হত্যা করতে শুরু করে। এভাবে মধুখালি, শিমুলিয়া, দোশিতনা গ্রামের ১০-১২ জন নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয় শুধু তাদের নাম জলিল হওয়ার কারণে। মজার ব্যাপার ছিল ওই অঞ্চলের কোনো মানুষকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে গেলে তারা নিজেদেরকে পরিচয় দিতো রকেট জলিল নামে। তাদের ধারণা ছিল রকেট জলিল নাম শুনলেই পাকবাহিনী ভয়ে ছেড়ে দিবে। কিন্তু এ নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথেই ব্রাশ ফায়ার টানা হতো তাদের বুকে। এতো এতো জলিলকে হত্যা করার পরেও যখন কিছুতেই আসল রকেট জলিলকে ধরা গেল না, তখন রীতিমত হকচকিয়ে যায় পাক কমান্ডোরা। শেষমেশ তারা জলিলের মাথার মূল্য এক লক্ষ টাকা ঘোষণা করেও ব্যর্থ হয় তাকে ধরাশায়ী করতে। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৭২ সালের গেজেটে রকেট জলিলকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তবে দুঃখের বিষয় জলিল তার খেতাবের কথা জানতে পারেন স্বাধীনতার প্রায় তিন দশক পরে, ১৯৯৭ সালে। ২০১৭ সালের ৮ই ডিসেম্বর এই বীর সেনানী চিরনিদ্রায় শায়িত হন।

লেখক: দৈনিক ইত্তেফাকের সহসম্পাদক। 

ইত্তেফাক/এসএএস