অসচ্ছল হৃদেরাগীদের চিকিত্সা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারীভাবে দেশের একমাত্র হৃদরাগের পূর্ণাঙ্গ চিকিত্সাপ্রতিষ্ঠান রাজধানীর শের-ই-বাংলা নগরের জাতীয় হৃদরাগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালকে। সরকারি বরাদ্দ পর্যাপ্ত না হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান সংগ্রহ করে চিকিত্সাসেবা অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
৪১৪ বেডের এই হাসপাতালটি বর্তমানে ১ হাজার ২৫০ বেডে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ রয়েছে সেই আগের মতোই। যা প্রয়োজনের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। ফলে সঠিক চিকিত্সা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সরকারের কাছে বরাদ্দ বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি জনবল সংকটের সমাধান প্রয়োজন।
গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে চিকিত্সা পেয়েছেন ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৩০৭ জন। ৪১৪ বেড থাকাকালীন হাসপাতালটিতে এমএসআর সরঞ্জামাদি খাতে বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি টাকা। এখন ১ হাজার ২৫০ বেডে উন্নীত হওয়ার পরও বরাদ্দ সেই একই রয়েছে। অথচ এই মুহূর্তে এই বরাদ্দ বৃদ্ধি করে অন্তত ৮০ কোটি টাকা করা প্রয়োজন বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া অসচ্ছল রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে অক্সিজেনেটর, ভাল্ব, স্টেন্ট, ডিভাইস ও প্রেসমেকারসহ অন্যন্য সরঞ্জামাদি কেনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আগে বরাদ্দ দেওয়া হতো। বর্তমানে এই বরাদ্দ বন্ধ রয়েছে।
ফলে অসচ্ছল রোগীদের চিকিত্সা ও জটিল অপারেশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই খাতে এই মুহূর্তে অন্তত ২০ কোটি টাকা সরকারের কাছে চাওয়া হয়েছে। সরকারি তহবিল থেকে এই খাতে যে টাকা পাওয়া যায় তা প্রয়োজনের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ।
জাতীয় হৃদরাগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, আর্থিক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও একজন রোগীকেও আমরা ফেরত পাঠাই না। শতভাগ রোগীর ক্ষেত্রে আমরা চিকিত্সাসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিশেষ করে অসচ্ছল রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘অসহায় রোগী সেবা তহবিলে’ অনুদান এনে চিকিত্সাসেবা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সত্যিকারের যারা অসচ্ছল তাদের ব্যাপারে এই তহবিলের কমিটি সুপারিশ করে। ফলে এখানে সঠিক মানুষটিকেই সহযোগিতা করা হয়।
গত বুধবার সরেজমিনে হাসপাতালটি পরিদর্শন করে দেখা গেছে, হাসপাতালটিতে সব ধরনের রোগীই আসে। তবে রোগীদের মধ্যে অধিকাংশ অসচ্ছল রোগী। বেড খালি না থাকলেও কোনো রোগী আসলে তার ভর্তি নিশ্চিত করা হয়। অনেকেই বেড না পেয়ে ফ্লোরে থেকে চিকিত্সা নিচ্ছেন। অনেক রোগী চিকিত্সা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হূদেরাগীদের ক্ষেত্রে একমাত্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া অন্য সকল সরকারি হাসপাতালে বেড খালি নেই বলে রোগীদের হূদেরাগ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। এই হাসপাতালে রোগী পৌঁছলে ভর্তি নিশ্চিত করা হয়। তার চিকিত্সা শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানিয়েছেন, সময় মতো চিকিত্সা পেলে সব ধরনের হূদেরাগী সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু অনেক সময় হাসপাতালে আসতে আসতে রোগীদের দেরি হলে দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হয়। ফলে সঠিক সময়ে চিকিত্সা শুরু করা জরুরি। সম্প্রতি হাসপাতালের পরিচালক উদ্যোগ নিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্ধলক্ষ টাকা এনে চারটি শিশুর অক্সিজেনেটর কিনে দিয়েছেন। সেই শিশুগুলো এখন সুস্থ আছে।
সরকারি হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ আগে ছিল রাজস্ব খাতে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাজস্ব খাত থেকে বাদ দিয়ে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। ফলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে লুটপাটের এক আখড়ায় পরিণত হয়। থার্ড পার্টি যে টাকা সরকার থেকে পেত তার অধিকাংশই তারা রেখে কর্মীদের খুবই অল্প টাকায় নিয়োগ দিত। ফলে কর্মীদের মধ্যে ভয়াবহ অসন্তোষ ছিল। বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০৭ জন আউট সোর্সিং কর্মীর বেতন রাজস্ব খাত থেকে পরিশোধের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে তাদের বেতন ভাতা নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি হাসপাতালটির মধ্য ব্লকের সিভিল ওয়ার্ক শেষ হলেও ইলেকট্রিক, এসিসহ অন্য কাজের বাজেট না থাকায় চালু করা সম্ভব হবে না। এ জন্য সরকারের কাছে ৪ কোটি টাকা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
হূদেরাগ হাসপাতালে এনজিওগ্রাম, প্রেসমেকারসহ হূদেরাগীদের সকল ধরনের পরীক্ষার সুযোগ আছে। এখানে ল্যাবরেটরি ও ব্লাড ব্যাংক ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। তবে টেকনোলজিস্ট সংকটের কারণে সব সময় এগুলো চালু করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে দালাল, টাউট বাটপারদের উত্পাত বন্ধ করেছে বর্তমান প্রশাসন। একই সঙ্গে বন্ধ হয়েছে সব ধরনের অনিয়ম।