বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল ও লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) শুনানির জন্য আগামীকাল মঙ্গলবার (১৩ মে) আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে দলের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ফিরে পেতে করা একটি আলাদা আবেদনও একইদিন শুনানির জন্য কার্যতালিকায় যুক্ত হয়েছে।
সোমবার (১২ মে) বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিষয়টি শুনানির জন্য দ্বিতীয় ক্রমিকে তালিকাভুক্ত হয়েছে। আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জানান, প্রতীক নিয়ে করা আবেদনটিও একই আপিলের সঙ্গে সংযুক্ত (ট্যাগড) হয়েছে।
প্রতীক নিয়ে বিতর্ক: দাঁড়িপাল্লা কি ফিরে পাবে জামায়াত?
জামায়াত তাদের আবেদনপত্রে উল্লেখ করেছে যে, দলটি অতীতে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক ব্যবহার করত। কিন্তু ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভায় গৃহীত একটি রেজল্যুশনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে বলা হয়—দাঁড়িপাল্লা কেবলমাত্র ‘ন্যায়বিচারের প্রতীক’ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে এবং অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি এই প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে জামায়াত এখন চায়—নিবন্ধন ফিরে পেলে পুরনো প্রতীকও ফেরত দেওয়া হোক।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জানান, যেহেতু আপিল বিচারাধীন অবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট রেজল্যুশন পাস করেছে, তাই এটি অপ্রাসঙ্গিক বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। এই যুক্তিতে প্রতীক সম্পর্কিত আবেদনের নিষ্পত্তির দাবিও করেছে জামায়াত।
নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার ইতিহাস ও আইনি লড়াই:
২০০৯ সালে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২৫ জন ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট করেন। দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে রায় দিয়ে বলে—বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের যোগ্য নয় এবং নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নিয়মিত আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করে। কিন্তু একই বছরের ৫ আগস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত জামায়াতের আপিল স্থগিতের আবেদন খারিজ করে। এরপর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন প্রজ্ঞাপন জারি করে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে।
আদালতে শুনানি, খারিজ ও পুনরুজ্জীবন:
২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর দলটির করা আপিল ও লিভ টু আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ, কারণ সেদিন আদালতে জামায়াতের পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। পরে দেরির কারণ দেখিয়ে পুনরুজ্জীবিত চেয়ে আবেদন করলে আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর সেটি মঞ্জুর করে। এরপর থেকেই পুনরায় শুনানি শুরু হয় এবং সর্বশেষ তা আবার কার্যতালিকায় এসেছে।
জামায়াত নিষিদ্ধের আদেশ ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন:
২০২৪ সালের ১ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনের পর ওই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেওয়া হয়।
পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে দেশ:
জামায়াতের নিবন্ধন বৈধতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবে কি না এবং প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ফিরে পাবে কি না—তা নির্ভর করছে আপিল বিভাগের এই গুরুত্বপূর্ণ শুনানির ওপর। রাজনৈতিক অঙ্গন, নির্বাচন কমিশন এবং জনগণ সকলেই আপাতত আদালতের রায়ের অপেক্ষায়।