সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

প্রচণ্ড গরমে সুস্থ থাকতে চিকিৎসকদের পরামর্শ

  • প্রসূতি মায়েরা দিনের প্রচণ্ড গরমে ঘরে থাকবেন—স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রওশর আরা বেগম 
  • বিশুদ্ধ পানি সঙ্গে রাখতে হবে: ডা. শোয়েব বিন ইসলাম
আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ০৬:০০

প্রকৃতিতে বইছে লু হাওয়া। বাতাসে আগুনের তাপ গায়ে লাগছে। পিছ ঢালা পথে বেরুলে ওপর-নিচ দুই দিক থেকেই তাপ এসে অস্থির করে তুলছে। এমন তাপপ্রবাহে ঘরে-বাইরে অতিষ্ঠ নগরবাসী। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সারা বিশ্বেই তাপমাত্রা বেড়েছে, তবে বাংলাদেশে সেটা অন্যান্য দেশের চেয়ে কিছু বেশি। বৈশাখ শেষে সূর্যের তেজ যেন প্রকৃতিকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাপপ্রবাহের ফলে বাড়ছে রোগ-বালাই। তীব্র গরমে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। প্রকৃতির বৈরী আচরণে দুর্বল মানুষগুলোর শরীরে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা নানা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ভোগেন। বিশেষ করে প্রসূতি নারী, শিশু ও বয়স্করা এর শিকার।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, প্রকৃতিতে তাপমাত্রার পরিবর্তনের সময়ে সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, সিওপিডি, টনসিলাইটিস, ফ্যারিঞ্জাইটিস, সাইনোসাইটিসে আক্রান্ত হন মানুষ। দেশ জুড়ে হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর। তীব্র গরমকে মোকাবিলা করতে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, পরিবেশের তাপমাত্রার ওঠা নামার কারণে পরিবেশে বাসকরা কতগুলো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে আমরা দেখতে পাই ভাইরাসজনিত শিশুদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং বড়দের ডায়রিয়া বেড়ে যায়। গরমের সময় মানুষ পিপাসার্থ হয়ে সামনে যে পানিই পায় সেটাই পান করে। ফলে পানিবাহিত ও খাদ্যবাহিত রোগ ডায়রিয়া, ডিসেনট্রি, জন্ডিস, টাইফয়েড এবং যত্রতত্র পানি পান করার জন্য পানিতে থাকা ময়লার কারণে ফুড পয়জনিং হয়। তারা বলছেন তীব্র গরম ঘাম দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় ফুডপয়জন, পানিবাহিত রোগ, হিটস্ট্রোক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুর মতো ঘটনা দিয়ে। আর শিশুদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া—এটিও শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। প্রসূতি নারী ও বয়স্করা  সংবেদনশীল ব্যক্তি, তারাই বেশি ভোগেন এ ধরনের বৈরী আবহাওয়াতে।  

প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন বাংলাদেশ অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির-(ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রওশর আরা বেগম ইত্তেফাককে বলেন, তীব্র গরমে গর্ভবতী মায়েদের ঠাণ্ডা জায়গায় থাকতে হবে। কোনোভাবেই বেশি ঘাম যেন না হয়, কারণ ঘাম বসে গিয়েও ঠাণ্ডা লাগে এবং এ থেকে সর্দি-কাশি-জ্বর হচ্ছে। ফলে প্রসূতি মায়েরা দিনের তীব্র গরমে ঘরে থাকবে। বেশি করে পানি পান করবে, পারলে ডাবের পানি, ফলের জুস পান করবে। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, প্রসূতি মায়েদের গরম বেশি অনুভূত হয়, ফলে তাদের ঘামও বেশি হয়, এই ঘাম বসেই ঠাণ্ডা লাগে তাদের, তারা সুতির আরামদায়ক পোশাক পরিধান করবেন।

আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ—আইসিডিডিআর,বি ঢাকা হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল লিড ডা. শোয়েব বিন ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, গরম শুরু হয়েছে, ডায়রিয়া কিছু বেড়েছে, তবে এখনো অনেক বেশি বাড়েনি। এই গরমে সবার জন্যেই এক ধরনের পরামর্শ—গরমে মানুষ পানি বেশি পান করে, সেক্ষেত্রে পানিটা যেন বিশুদ্ধ হয়। নিজের বাসার বিশুদ্ধ পানি সব সময় সঙ্গে রাখতে হবে। বাচ্চারা স্কুলে গেলে পানি পান করবে, সেটা যেন বিশুদ্ধ হয়। কারণ অনেক স্কুলেই বিশুদ্ধ পানির সুবিধাটা থাকে না। স্কুলগুলোতেও বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ রাখতে হবে। এছাড়া যারা বাইরে বের হয়, তারা যেন ঢিলেঢালা পোশাক পরেন। এই গরমে হিটস্টোক হয়, তীব্র গরমে হঠাৎ যদি কোনো ব্যক্তির খারাপ লাগে, মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে, কিংবা মাথাঘুরে পড়ে যায়, তখন তাকে দ্রুত খোলামেলা ঠান্ডা জায়গায় নিতে হবে এবং তাকে শুইয়ে দিয়ে, পা কিছুটা উঁচু করে দিতে হবে, এরপর অবস্থা বুঝে তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, তীব্র গরমে মানুষ বাইরে যখন যায়, তখন ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে পানি এবং লবণ বেরিয়ে যায়, ফলে শরীরে পানি শূন্যতা তৈরি হয় এবং লবণের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে পিপাসা বেশি পায়, মাথা ঘোড়ে শরীর অবসন্ন লাগে, রক্তচাপ কমে যায় এবং তীব্র গরমে ‘হিটস্ট্রোক’ নামে একটি সমস্যা হয়, মানুষ এ সময় জ্ঞান হারাতে পারে।  এ সময় রক্তের চাপ কমে যায়, নাড়ির গতি বেড়ে যায়, প্রথম দিকে অসংলগ্ন কথা বা আবলতাবল কথা বলতে থাকে এবং একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এটি হচ্ছে গরমের প্রাথমিক প্রভাব।

আর একটা হচ্ছে গরমের কারণে মানুষ অশস্থি বোধ করে, কর্মোদ্দীপনা কমে যায় বা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, এক ধরনের অবসাদ তৈরি হয়। এর বাইরে হঠাৎ গরম থেকে ঘরে এসে ঠাণ্ডা এয়ারকন্ডিশন রুমে বা ঠাণ্ডা পানি খেলে, শরীরের তাপমাত্রার হঠাৎ পরিবর্তন হয়, এই পরিবর্তনের কারণে শরীরের ভেতরে বাস করা সুবিধাবাদি যে রোগজীবাণুগুলো রয়েছে তা সক্রিয় হয়ে ওঠে, যে কারণে গলাব্যথা, ফ্যারিনঞ্জাইটিস, জ্বর কাশি হয়।

প্রতিকারে এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রতিদিন সকালে একটা সতর্কতা সংকেট জারি করা দরকার যে, ‘আজ তাপমাত্রা বেশি থাকবে’, অতএব যারা সংবেদনশীল মানুষ—গর্ভবতী নারী, বয়স্কা মানুষ, নারী ও শিশু তারা যেন এ সময় তীব্র রোদে বের না হয়। বের হলেও সুতির ঢিলেঢালা জামা-কাপড় পরবে। গরমের কারণে যদি কেউ অবসন্ন হয়ে বসে পড়ে বা শুইয়ে পড়ে, তাহলে তাকে দ্রুত ছায়াযুক্ত জায়গায় নিতে হবে, তার শরীরে টাইট জামা-কাপড় থাকলে, তা ঢিল করে দিতে হবে, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। শরীরে পানির ছিটে দিতে হবে এবং ধীরে ধীরে অল্প অল্প পানি পান করাতে হবে। আর কেউ যদি পড়ে গিয়ে অসংলগ্ন কথা বলতে থাকে, বা ঢলে পড়ে যায়, তাহলে তাকে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, যারা দীর্ঘদিন রোগে ভুগছে, তাদের শরীরে তো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম থাকে, তারা যেন তীব্র রোদে বের না হয়।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন