সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

লানা আল-শরীফ: গাজার এক শিশুর গল্প, যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে যার শৈশব

আপডেট : ১৭ মে ২০২৫, ১৭:৫৪

গাজায় ইজরায়েলের নৃশংসতা হাজারো শিশুর শৈশবকে কেড়ে নিয়েছে। এমনই এক ছোট্ট শিশু লানা আল-শরীফ। তার বয়স যখন মাত্র আট তখন শুরু হয় গাজায় ইজরায়েলের গণহত্যা। বয়সে ছোট হলেও বাস্তবতার নির্মমভারে সে যেন এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। লানা এখন সবার কাছে পরিচিত “বড় শিশু” নামে। কারণ, তার চোখে ঘুম নেই, হাসিতে প্রাণ নেই, আর গালে নেই আগের সেই উজ্জ্বলতা।

ইসরায়েলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজার খান ইউনিসের এক অস্থায়ী শিবিরে বসবাস করছে লানার পরিবার। দিনের পর দিন চলা বিমান হামলা, ক্ষুধা, পানি সংকট, ঘর হারানোর বেদনা এবং প্রিয়জনদের হারানোর যন্ত্রণায় ফিলিস্তিনের লাখো শিশুর মতো লানাও হারিয়ে ফেলেছে তার শৈশব।

আতঙ্কের রাতে হারিয়ে যায় শরীরের রঙ:

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, গাজার ওপর ইজরায়েলি বাহিনীর বর্বর বিমান হামলার এক রাত। চারপাশে বোমা, গুলির শব্দ, ধুলোয় ঢেকে গেছে আকাশ। সেই রাতে আতঙ্কে কাঁপছিল ছোট্ট লানা। শরীরের কাঁপুনি থামছিল না। বাবা-মা তখন ভেবেছিলেন, হয়তো ভয় পেয়েছে, কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু ঠিক হয়নি। তার বাবা খলিল আল-শরীফ বলেন, সেই রাতে লানা সারা রাত কাঁপছিল। পরদিন হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসক বললেন, এটা তীব্র আতঙ্ক-জনিত মানসিক আঘাত—সাধারণত যুদ্ধের সময় শিশুদের এমন হয়। সেই রাতের যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব আর সয়ে উঠতে পারেনি লানার ছোট্ট শরীর। 

শুরু হয় সাদা দাগ, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে শরীরে:

সেই ঘটনার দুই দিন পর, লানার মুখে দেখা দেয় প্রথম দুটি সাদা দাগ। তার বাবা খলিল বলেন, প্রথমে মনে করেছিলাম কিছুই না, হয়তো চুলকানো থেকে দাগ হয়েছে। কিন্তু তা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লানার মুখ, হাত, পা—সব জায়গায় সাদা দাগ ছড়িয়ে পড়ে।
চিকিৎসকরা জানান, লানা আক্রান্ত হয়েছে ভিটিলিগো নামক এক জটিল অটোইমিউন রোগে। আতঙ্ক এবং মানসিক ধাক্কা এর অন্যতম কারণ। এই রোগে ত্বক রঞ্জকতা হারিয়ে ফেলে, সাদা ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। চোখের জল মুছতে মুছতে তার বাবা বলেন, আমার মেয়ের মুখে এখন আর আগের সেই হাসি নেই। তার চুল ধূসর হয়ে যাচ্ছে। এটা শুধু একটি রোগ নয়—এটা একটা যুদ্ধের ক্ষত। য়ার ধকল বয়ে বেড়াচ্ছে লানার মতো হাজারো শিশু। 

একজন যুদ্ধ-শিশুর মানসিক ভাঙনের অনুপম চিত্র:

বর্তমানে গাজা হলো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু PTSD আক্রান্ত এলাকা। ইউনিসেফ ২০২৪ সালের এক রিপোর্টে জানায়, ১.২ মিলিয়ন শিশুর প্রায় সবাই মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে রয়েছে। তাঁদের দরকার জরুরি মানসিক ও মানবিক সহায়তা। বিশেষজ্ঞদের মতে, গাজার মতো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলে শিশুদের মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক রূপও নিতে পারে। যেমনটা হয়েছে লানার ক্ষেত্রে। মানসিক আঘাত থেকে তার শরীরও আজ জর্জরিত। একজন মনোরোগ চিকিৎসক জানান, একটি শিশু যখন প্রতিনিয়ত মৃত্যু দেখে, দগ্ধ দেহ, ধ্বংস, ক্ষুধা দেখে—তার মনে স্থায়ী ছাপ পড়ে। আর এই মানসিক যন্ত্রণা শরীরে ফুঁড়ে বের হতে থাকে।

লানা আল-শরিফ, যিনি এখন বেশিরভাগ সময় একা কাটান, তিনি বলেন যে মানুষ তার দিকে যেভাবে তাকায় তাতে তিনি কষ্ট পান। ছবি: সংগৃহিত

লানা এখন আর আগের মতো খায় না, হাসেও না : 

লানার মা ফাতেমা বলেন, ও আর খায় না ঠিকমতো। অন্যদের সঙ্গে কথা বলে না। আয়নার দিকে তাকায় না। মাঝে মাঝে রাতের বেলা একা একা কেঁদে ওঠে ঘুমের মধ্যে।
একটা সময় লানা খেলতো, দৌড়াতো, গান গাইতো। এখন সে এক কোণে বসে থাকে। নিজের ছবি দেখে, যা তুলেছিল যুদ্ধ শুরুর আগে। সেই ছবির মেয়েটির চোখে ছিল স্বপ্ন—এখন সে চোখে কেবল ভয়ের ছাপ। 

চিকিৎসা নেই, শান্তি নেই, কেবল যুদ্ধ: 

লানার পরিবার চায় তাকে উন্নত চিকিৎসা দিতে। কিন্তু গাজায় এখন সব ধ্বংস। হাসপাতালগুলো হামলার শিকার, ওষুধ নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি পর্যন্ত নেই। যেসব ওষুধ দেওয়া হয়, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। “আমরা ওকে রক্ষা করতে পারছি না। এই অপরাধবোধ আমাদেরও গ্রাস করে ফেলছে,” বলেন খলিল।

দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিসে একটি বাস্তুচ্যুত তাঁবুর ভেতরে যুদ্ধের আগে তোলা নিজের একটি ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন লানা আল-শরীফ। ছবি: সংগৃহিত

একটি ছবি, একটি শৈশব, একটি হারিয়ে যাওয়া রঙ: 

একদিন লানা তার পুরনো ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ছবিতে রয়েছে যুদ্ধের আগের হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত লানা। এখনকার লানা সেই ছবির দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে, যেন নিজের হারানো সত্ত্বাকে খুঁজে ফেরে।

লানা এখন একটি জীবন্ত প্রশ্নচিহ্ন পৃথিবীর কাছে। এই যুদ্ধ কত শিশুর জীবন, রঙ, হাসি কেড়ে নিচ্ছে। গাজার শিশুদের চোখে এখন আর স্বপ্ন নেই, আছে আতঙ্ক, ভাঙা স্বপ্নের ছায়া। যে শিশুর ত্বকের রঙ মুছে যাচ্ছে, তার সঙ্গে মুছে যাচ্ছে পৃথিবীর মানবতার মুখও।

তথ্যসূত্র: মিডেল ইস্ট আই

ইত্তেফাক/টিএস