মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

আসামির জামিন নাকচ, বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ আইনজীবীদের

আপডেট : ১৮ মে ২০২৫, ১১:২৭

হত্যাচেষ্টা মামলায় জামিন আবেদনের আদেশ পছন্দ না হওয়ায় বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের এক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। শনিবার (১৭ মে) দুপুরে ঢাকার বিচারিক হাকিম আদালতে এ ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার একটি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হানিফ মেম্বার গত ১২ মে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। গত বৃহস্পতিবার তার জামিন চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবী। শনিবার ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারক আদেশ দেওয়ার পর অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন আইনজীবীরা।

আদালতের বেঞ্চ সহকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, হানিফ মেম্বার নামে এক আসামির জামিন শুনানির দিন ধার্য ছিল। খোরশেদ আলমসহ কয়েকজন আইনজীবী জামিন শুনানি করেন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করেন। পরে আইনজীবীরা স্যারের সঙ্গে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। ফ্যাসিবাদের দোসর, দালাল বলেন। আদালতের কজলিস্ট ছুড়ে ফেলে দেন।

তিনি আরও বলেন, স্যার জামিন নামঞ্জুরের অর্ডার দেন। তখন আইনজীবীরা বিষয়টা পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। স্যার বলেন, অর্ডার তো দিয়ে দিয়েছি। যদি আবার শুনানি করতে চান তাহলে সিজেএম স্যারের কাছে স্পেশাল পুট আপ দিতে পারেন। প্রয়োজনে আমি আবার শুনবো। কিন্তু তারা- তা না করে শুনানি করতে জোরাজুরি করেন। স্যার বলেন, প্রকাশ্য আদালতে জামিন নামঞ্জুর হয়েছে। এরপর তারা স্যারের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন, হুমকি দেন।

এ ঘটনার একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে। সেখানে দেখা যায়, আইনজীবী খোরশেদ আলম এক নথি দেখিয়ে বিচারককে বলছেন, ঘটনার তারিখ, ঘটনার সময়, ঘটনার স্থান সেইম- দুইটা মামলা (বাদী আলাদা); এটা হয় নাকি? এরপর তিনি এজলাস ত্যাগ করেন।

এ সময় আবদুল খালেক মিলন নামে এক আইনজীবী উচ্চস্বরে বলেন, শোনেন, আজকে যে আমরা কথা বলি, যদি ৫ তারিখ শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করত- আমরা গুম হতাম, খুন হতাম। আমরা সিএমএম কোর্টে রাজনীতি করেছি। ৮০ বছরের একজন লোক স্যারেন্ডার করেছে।

এ সময় আরেক আইনজীবী বলেন, আমরা শুনানি করে চলে গেছি। উনি (বিচারক) জিআরওকে (আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা) বলেন, ‘আপনি ভয় পেয়েছেন’। আমরা কি এখানে ভয়ের কিছু করেছি?

আবদুল খালেক মিলন বলেন, শোনেন স্যার, বলতে তো এখন খারাপ শোনা যায়, আমাদের কারণে আজ এই চেয়ারে বসা আপনি। নইলে আপনি এখানে থাকতে পারতেন না। আমরা যে কষ্ট করছি গত ১৭ বছর। ৪ তারিখের (অগাস্টের) ঘটনা সিসিটিভি ফুটেজে দেখেন। অন্যায় কোনো আবদার করিনি। ৫ অগাস্টের পর আজ পর্যন্ত কোনো কোর্টে তদবির করিনি। সবাই বলছে; না- আমি যাই না।

ওই সময় এক আইনজীবী বলেন, আমরা পুনরায় জামিনের একটা আবেদন করি। আপনি কালকে শুনানির জন্য রাখেন। তখন বিচারক বলেন, আপনারা স্পেশাল পুটআপ নিয়ে সিজেএম স্যারের কাছে যান।

এরপর এক আইনজীবীকে বলতে শোনা যায়, আপনি কালকে একটা ডেট রাখেন। তাহলে আমরা বাঁচতে পারি। না হলে আমরাও বাঁচতে পারি না। কাল শুনানির জন্য রাখেন। বাদীকে নিয়ে আসব।

এ সময় শোনা যায়, ‘যান যান’। তখন এক আইনজীবী ধমকের সুরে বলেন, ‘চুপ’। এ সময় আইনজীবীরা বিচারককে লক্ষ্য করে বলেন, এ আওয়ামী লীগের দালাল। এক আইনজীবী গালিও দেন।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আবদুল খালেক মিলন বলেন, বৃহস্পতিবার আমরা হানিফের জামিন আবেদন করি। শনিবার শুনানির জন্য ছিল। শুনানির পর জামিন নামঞ্জুর হয়। আমরা চলে আসি। পরে (বিচারক) জিআরওকে ধমকান। বলেন, ‘আপনি কি ভয় পান জামিনের বিরোধিতা করতে’। জিআরও আমাদের সাপোর্ট করেছে।

তিনি বলেন, আমরা বলি নেগেটিভ (জামিন নামঞ্জুর) কিছু হলে রিকলের আবেদন করি। উনি শোনেননি। পিটিশন রাখেননি। উল্টো জিআরওকে ধমকান।

গত ৬ মে হানিফ মেম্বারসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৭০-৮০ অচেনা ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন ফজলুল হক নামের এক ব্যক্তি।

মামলার বিবরণে বলা হয়, কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার শাক্তা ইউনিয়নের আরশিনগরে ১৩ শতাংশ জমির ওপর বাড়ি করেছেন বাদী। তবে আসামিরা জমিটি ‘দখলের পাঁয়তারা’ করছে। গত ২৫ ও ২৭ জানুয়ারি বাদীকে গালিগালাজ করে জমিটি ছেড়ে দিতে বলা হয়। জমি না ছাড়লে বাদীকে ‘মেরে ফেলার হুমকি’ দেওয়া হয় বলে এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়, আসামিরা গত ৫ মে ফজলুল হকের বাড়িতে গিয়ে ‘ভাংচুর’ চালায়। তার কেয়ারটেকারকে ‘হত্যার উদ্দেশ্য’ হাত পা বাঁধে। তখন ফজলুল হকের স্ত্রী এগিয়ে এলে আসামিরা ‘যৌন নিপীড়ন’ করে।

বাদী মামলায় বলেছেন, আসামিরা তার বাড়ির দেয়াল ভাঙার পাশাপাশি জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়। তাতে ১০/১১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। এ সময় আসামিরা ‘এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি’ করে বলেও এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে।

মামলার বাদী ফজলুল হক বলেন, হানিফ মেম্বার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ১৫ বছর নির্বাচন ছাড়া শাক্তা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ছিল। লোকজন নিয়ে জমি দখল করত। সে নৌকা বাইত। বৃষ্টি নামলে ঘরে থাকতে পারত না, ভিজে যেত। এখন সে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। বহু মানুষের জমি দখল করছে। জালিয়াতি করে মসজিদের জমিও রেজিস্ট্রি করে বিক্রি করছে। এক পাগলের ২৪ শতাংশ জমি জাল করে বিক্রি করছে। তিতাস গ্যাসের লাইন এনে দেবে বলে হাজার হাজার লোকের কাছ থেকে এক লাখ/দেড় লাখ করে টাকা নিয়েছে। অবৈধ গ্যাসের লাইন এনে দিয়েছিল। তবে কিছুদিন পরে তিতাস এসে লাইনের গ্যাস কেটে দেয়। আমি হজে থাকা অবস্থায় আমরা বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দেয়। আরও দুইটা মামলাও করে।

বাদী ফজলুল আরও বলেন, আমার দুইটা প্লট। একটা প্লট জেসমিন নামের একজনের কাছে বিক্রি করেছি, আরেকটিতে আমি আছি। জেসমিন ধানমন্ডিতে থাকে। তার বাড়ি-ঘর ভাংচুর করে, সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যায়। আমার জমি দখলের চেষ্টা করে, কেয়ারটেকারকে মারধর করে। আমার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করে। আমি মামলা করছি। হানিফ জেলে থেকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। আগে একদিন কোর্টে গিয়ে জামিনের বিরোধিতা করি। উকিলরাও হুমকি দিছে। দাঁড়াইতে পারিনি। মন্ত্রীর চেয়ে তার প্রভাব বেশি। কেরাণীগঞ্জে কামরুল সাহেব (সাবেক এমপি) এর ১০ ভাগের দুই ভাগও প্রভাব দেখাতেন না- ও যা দেখায়।

ইত্তেফাক/কেএইচ