বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

নিরাপত্তারক্ষী ও ধনেপাতা বিক্রেতা থেকে বলিউডের শীর্ষ অভিনেতা

আপডেট : ১৯ মে ২০২৫, ১৬:৪৭

বলিউডের অন্যধারার অভিনেতা হিসেবে ইরফান খানের পর যে নামটি সবথেকে বেশি উচ্চারিত হয়, তিনি নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। অর্থকষ্টে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন, টিকিট ছাড়াই ট্রেনে চেপে বসা ছিল নিয়মিত ঘটনা। পরে সিনেমায় অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাই এসেও শুরুতে সুযোগ হয়নি। কখনো কখনো সুযোগ মিলত এক্সট্রা চরিত্রে, পারিশ্রমিক হিসেবে যা মিলত, বেশির ভাগই দিয়ে দিতে হতো কাস্টিং সমন্বয়কারীদের। অথচ তার এখন মুম্বাইয়ের বুকে রাজপ্রাসদসম বাড়ি।

সোমবার (১৯ মে) জীবনের আরও একটা বসন্ত পার করে ফেললেন হিন্দি সিনেমার এই সময়ের অন্যতম শীর্ষ অভিনেতা, তার বয়স বেড়ে হল ৫১। জন্মদিন উপলক্ষে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমস, বলিউড হাঙ্গামা ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অবলম্বনে জেনে নেওয়া যাক অভিনেতার জীবনের নানা জানা-অজানা কথা।

ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ১১৪টিরও বেশি ছবি এবং সিরিজে কাজ করে ফেলেছেন নওয়াজ। এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪২ টিরও বেশি পুরস্কার জিতেছেন। তাকে অভিনয়ের সুপারস্টার বলা হয়। তবে নওয়াজের এই তারকা খ্যাতির পেছনে অমসৃণ ছিল তার পথচলা।

  সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। ছবি: সংগৃহীত

উত্তর প্রদেশের একটি ছোট শহর বুধানায় জন্ম হয় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির। ৮ ভাইবোনের থেকে তিনিই বড়। যৌবনের বেশিরভাগ সময় তিনি উত্তরাখণ্ডে কাটিয়েছেন। তিনি হরিদ্বারের গুরুকুল কাংরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর, তিনি এক বছর ধরে ভাদোদরায় কটি পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানিতে রসায়নবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। পরে নতুন চাকরির সন্ধানে দিল্লি চলে যান।

অভিনেতা জমিদার পরিবার থেকে এসেছেন ঠিকই তবে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি পরিবারের সাহায্য নেননি। আর তাই শুরুর দিকে নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য তাকে নানান কাজও করতে হয়েছে তাকে। দিল্লিতে থাকার সময় নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজও করেছেন অভিনেতা। আবার কখনও ধনেপাতাও বিক্রি করেছেন নওয়াজউদ্দিন।

পরে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে পড়াশোনার পর তিনি অভিনয়ে আসেন। তবে তার চেহারার জন্য বহুবার প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে। একবার এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা নিজেই স্বীকার করে নেন, তিনি সুন্দর হতে একসময় ফেসারনেস ক্রিমও লাগাতেন।

সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। ছবি: সংগৃহীত

আমির খান অভিনীত ১৯৯৯ সালের সিনেমা ‘সারফারোশ’-এ ছোট একটা চরিত্রে অভিনয় করেন। এলাকার ছোট এক গুন্ডার চরিত্রে দেখা যায় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীকে। সেই থেকেই শুরু। এরপরে তাকে প্রশংসা এনে দেয় ইরফান খানের সঙ্গে জুটি হয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যে অভিনয়। তারা অভিনয় করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য বাইপাস’-এ। বিএফআই লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মনোনয়ন পায়। কিন্তু বড় চরিত্র তখনো অধরাই ছিল।

২০১২ সালের অনুরাগ কাশ্যপের গ্যাংস্টার মহাকাব্য ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ সিনেমায় নাম লিখিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। তার চরিত্রের নাম ছিল ‘ফয়জাল খান’। সিনেমাটি দিয়ে দর্শকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পান নওয়াজ। সে বছরই তিনি নাম লেখান ‘কাহানি’, ‘পাতাং’, ‘পান সিং তুমার’, ‘চিটাগং’, ‘তালাশ’, ‘মিস লাভলি’ সিনেমায়। পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

এর আগে রাজকুমার হিরানির ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ সিনেমায় পকেটমারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সিনেমায় একটি দৃশ্য ছিল। তখনো সিনেমার মূল অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি। বড় বড় সিনেমায় ছোট চরিত্রে কাজ করলেও সেসব সিনেমার তারকাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হতো না। এমন শত শত বঞ্চনাই এই অভিনেতাকে সাহস জুগিয়েছিল।

সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। ছবি: সংগৃহীত

খ্যাতির পর বেড়ে চলে অভিনয়ের পথচলা। একে একে ‘মুনসুন শুটআউট’, ‘দ্য লাঞ্চবক্স’, ‘আনওয়ার কা আজব কিস্‌সা’, ‘বদলাপুর’, ‘বজরঙ্গি ভাইজান’, ‘মাঝি: দ্য মাউন্টেনম্যান’, ‘লায়ন’, ‘রইস’, ‘হারামখোর’, ‘মম’, ‘মান্টো’, ‘রাত আকেলি হ্যায়’ নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর অভিনয়যাত্রা চলছেই।

ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করতে করতে আজ বড় তারকা হয়েছেন বলিউডের নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। তার দীর্ঘ পথ ছিল কাঁটা বিছানো। এমন দিনও গেছে, যখন তাকে ধনেপাতা বিক্রি করতে হয়েছে। চাইলেও সেই দিন আর ফিরবে না। একবার ২০০ রুপির ধনেপাতা কিনেছিলেন নওয়াজউদ্দিন। সেগুলো খুচরা বিক্রি করেন কিছু লাভ করার জন্য। পাতাগুলো ক্রমেই বাদামি রং ধারণ করতে শুরু করলে তিনি দৌড়ে পাতাওয়ালাকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার পাতা তো মরে যাচ্ছে।’ পাতাওয়ালা তাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ‘বারবার পানি ছিটাতে হবে, তাহলেই পাতা সতেজ থাকবে।’ নওয়াজের পকেটে সেদিন তেমন টাকা ছিল না। টিকিট ছাড়া রেলগাড়িতে চড়েছিলেন তিনি। কিন্তু নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ধনেপাতা ঠিকই বাদামি হয়ে গিয়েছিল। তার ২০০ রুপিই জলে গিয়েছিল সেদিন।

আরেকটি গল্প বলতে গিয়ে নওয়াজ বলেন, জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে একবার চার হাজার রুপি সম্মানী পান তিনি। সেদিন এই রুপির অর্ধেক তাকে দিয়ে দিতে হয়েছিল তার সমন্বয়কারীকে। বাকিটা থেকে হোটেলভাড়া দিয়েছিলেন ১ হাজার ৮০০ রুপি আর ২০০ রুপি দিয়ে রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।

সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। ছবি: সংগৃহীত

তবে এরপর অভিনয়শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরুর পর জীবনে যা যা হয়েছে, সেসব নিয়ে সন্তুষ্ট অভিনেতা। নওয়াজের ভাষ্যে, ‘অভিনয়জীবন নিয়ে আমি খুবই সন্তুষ্ট। একজন অভিনেতার উচিত, সব ধরনের ঘরানার জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলা। যে ধরনের ছবিতে কাজ করতে চেয়েছি, সুযোগ পেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার প্রতি আস্থা রেখেছেন পরিচালকেরা।’ ক্যারিয়ারের ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে গত বছর। এই ২৫ বছরে নানা বৈচিত্র্যময় চরিত্রে তাকে দেখা গেছে। তবে তার অভিনীত ছবির প্রদর্শনীর সংখ্যা আর সময় নিয়ে আক্ষেপও আছে। অভিনেতা বলেন, ‘আমাদের মতো অভিনেতাদের ছবি অত্যন্ত কম হল পায়। মাত্র দুটি শো পায়। তা-ও একটা সকাল, একটা রাতে। সেখানে তথাকথিত তারকাদের দখলে থাকে সিংহভাগ স্ক্রিন। আমার ‌‘আফওয়া’, ‘জোগিরা সারা রা রা’র ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল। এর চেয়ে ছবিগুলো ওটিটিতে মুক্তি পেলে ভালো হতো।’

নওয়াজকে ইদানীং বড় পর্দার চেয়ে ওটিটিতে দেখা যাচ্ছে বেশি। বড় পর্দা প্রসঙ্গে অভিনেতা বলেন, ‘বড় পর্দার একটা জাদু আছে নিশ্চয়। কিন্তু আমি তো মঞ্চের মানুষ, তাই আমার কাছে মাধ্যম গুরুত্ব পায় না। আমি একজন অভিনেতা, তাই ভালো অভিনয় করতে পারলেই খুশি।’

নওয়াজউদ্দিন জানান, কন্যা শোরা তার অভিনয়ের সবচেয়ে বড় সমালোচক। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘শোরা আমার ছবি খুব কম দেখে। কোনো ছবি যদিওবা দেখে, হাজারটা ভুল খুঁজে বের করে। নির্দয়ভাবে আমার সমালোচনা করে। আমি শোরার বয়সী, মানে ১৪-২০ বয়সীদের সমালোচনা খোলামনে গ্রহণ করি। কারণ, ওদের ওপর কারও প্রভাব থাকে না। তাদের সমালোচনা খুব খাঁটি হয়। আমাদের ওপর অন্যের প্রভাব থাকে।’

সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। ছবি: সংগৃহীত

নওয়াজ একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শোরা তার বাবার পথ অনুসরণ করতে চায়। এ প্রসঙ্গে অভিনেতা জানান, শোরা অভিনয়ে আসতে চায়। নওয়াজ বলেন, ‘আমি কখনো ওকে অভিনয়ে আসার কথা বলিনি, ওর ওপর অযথা চাপ সৃষ্টি হবে। তবে ও কখনো আমার কাছে কোনো পরামর্শ চাইলে, আমি নিশ্চয় দেব।’

অভিনেতাকে সবশেষ দেখা গেছে চলতি মাসেই জি-ফাইভে মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিনেমা ‘কোস্টাও’-এ। গোয়ার এক কাস্টমস অফিসার কোস্টাও ফার্নান্দেজের জীবন অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা এটি।

ইত্তেফাক/এসএ