জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’—এই নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘিরে শুরু হওয়া আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।গত রোববার রাতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অধ্যাদেশ সংশোধনের বিষয়ে আশ্বাস পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার থেকে ঘোষিত পূর্ণদিবস কর্মবিরতি স্থগিত করা হচ্ছে। তবে চার দফা দাবিতে দ্রুত অগ্রগতি না হলে আবারও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
এদিকে পূর্ণদিবস আন্দোলন স্থগিত করলেও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে কাটেনি অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ। সরকারের আশ্বাস কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন। কারও কারও মতে, আন্দোলন থামাতে কৌশল হিসেবে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম।
ঢাকায় কর্মরত এনবিআরের এক উপকমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা কার্যকর সংস্কার চাই, কিন্তু সেটা হতে হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে। আলাদা দুইটা প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করালে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি কমে যাবে। সমন্বয়ের অভাব হবে। রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। অতীতেও এমন বহু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এবারও যদি সময়ক্ষেপণ করা হয়, তাহলে এই দ্বিখণ্ডিত কাঠামো রাজস্ব প্রশাসন পুরোপুরি অকার্যকর করে ফেলবে।’
এনবিআরের আরেক অতিরিক্ত কর কমিশনার বলেন, ‘আন্দোলন থামাতে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, সেটা কতটা নির্ভরযোগ্য? বাস্তবে কোনো গেজেট বা সংশোধনী ছাড়াই শুধু কথার ভিত্তিতে কর্মসূচি স্থগিত, এই সিদ্ধান্ত অনেকের মধ্যেই শঙ্কা তৈরি করেছে।’
তার ভাষ্য— সরকার হয়তো চলমান আন্দোলন থামাতে এখন আলোচনার নামে সময় নিচ্ছে। উদ্দেশ্য হতে পারে আমাদের বিভক্ত করা।
এক সিনিয়র কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, ‘এই মুহূর্তে সবার মনে একটাই প্রশ্ন—আমাদের ভবিষ্যৎ কী?’
তিনি জানান, যদি ক্যাডারভিত্তিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে কর্মকর্তাদের দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার পরিকল্পনা অনিশ্চিত হয়ে যাবে।’
তার মতে, রাজস্ব প্রশাসনে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় থাকা জরুরি। একটিকে ‘নীতি’ আর অন্যটিকে ‘ব্যবস্থাপনা’ হিসেবে ভাগ করে দিলে ফাইল ঘুরবে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে। এতে প্রশাসনের চেয়ে দুর্নীতির সুযোগই বাড়বে বেশি।
তিনি আরও বলেন— ‘আমরা বহু বছর ধরে এই কাঠামোয় কাজ করছি। এখন হঠাৎ করে একটি অধ্যাদেশ দিয়ে গোটা অর্গানোগ্রাম বদলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ মাঠপর্যায়ের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। এতে আমাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আর ক্যারিয়ার গ্রোথ—সবকিছুই যেন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।’
এনবিআরের আরেক যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘সরকার যেহেতু সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে, আমরাও আশা করছি- শিগগিরই বিষয়টি সমাধান হবে। আমরা এখনই সরকারের প্রতিশ্রুতিতে অনাস্থা প্রকাশ করছি না। তবে, যদি বিষয়টি সমাধানে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দেখা গেলে; এনবিআরের পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে এবং তা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট হবে।। আর এমনটা হোক, আমরা চাই না।’
এর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি বিভাগ করে ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর পর থেকে এর প্রতিবাদে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছেন রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারির প্রতিবাদে গত রোববার সারা দিন আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনে কর্মবিরতি পালন করা হয়। বেশির ভাগ শুল্ক-কর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এনবিআরের নিচতলায় প্রধান ফটকের পাশেই সারা দিন অবস্থান করেন। ফলে এনবিআরের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ থাকে। এরমধ্যে গত দুই দিন ধরে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান নিজের কার্যালয়ে আসেননি।
এছাড়া শুধু এনবিআর নয়, ঢাকা কাস্টমস হাউস, চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল, ভোমরা স্থলবন্দরসহ দেশের অন্যান্য শুল্ক স্টেশনেও রোববার সারা দিন কর্মবিরতি চলে। গত কয়েক দিন ধরে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই আন্দোলন চলছে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবি মূলত চারটি। প্রথমত, জারিকৃত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করা। দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা। তিন, রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। চার, এনবিআরে প্রস্তাবিত খসড়া ও পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামত নিয়ে রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার নিশ্চিত করা।