রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস আজ

নিরাপদ মাতৃত্বের চ্যালেঞ্জগুলো এখনো বিদ্যমান

আপডেট : ২৮ মে ২০২৫, ০৫:০০

দেশে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, প্রসব-পূর্ববর্তী চার বার সেবা না নেওয়া, অদক্ষ ধাত্রীর হাতে প্রসব এবং অল্পবয়সে গর্ভধারণের ফলে এখনো মাতৃমৃত্যুর হার আশানুরূপ কমছে না এবং ৫৪ শতাংশ মাতৃমৃত্যু হচ্ছে বাড়িতে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রসব-পূর্ব চার বার সেবা পান না ৬১ শতাংশ গর্ভবতী। এ ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে আছেন গ্রামের গর্ভবতীরা। গ্রামের গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা পান না ৬৪ শতাংশ গর্ভবতী, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অনেক পিছিয়ে। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু অনিরাপদ মাতৃত্ব ও সন্তান প্রসবের কারণে এখনো দেশে প্রতি লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৩৬ জন মা মারা যাচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো গর্ভকালীন যত্ন, পুষ্টি বা জরুরি চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সচেতনতা এবং সুযোগের অভাব রয়েছে। বাল্যবিবাহ, অপ্রাপ্তবয়স্ক মাতৃত্ব, অপুষ্টি এবং দারিদ্র্য এসব মাতৃমৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত। অনেক জায়গায় এখনো দক্ষ ধাত্রী বা প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের অভাব, পর্যাপ্ত হাসপাতালের অপ্রতুলতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, রেফারেল ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা—গর্ভবতী নারীদের জীবন হুমকির মুখে পড়ছে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বৈষম্য এ সমস্যা আরও প্রকট করে তুলছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন গর্ভবতী নারীকে গর্ভাবস্থায় অন্তত চার বার গর্ভকালীন সেবা নিতে হবে। এই সেবার মধ্যে রয়েছে প্রসূতির শারীরিক পরীক্ষা, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান, চিকিৎসা সেবা প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের চিহ্নিত করে সেবা দেওয়া। প্রসূতি ও তার পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যৎ প্রসবের প্রকৃতি, সময় ও স্থান নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান।             

অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২৩ এর তথ্য বলছে— প্রসব-পূর্ব চার বারের বেশি সেবা পান ৩৯ শতাংশ গর্ভবতী নারী। অর্থাৎ ৬১ শতাংশ গর্ভবতী এখনো এই সেবা পান না। এই সেবার ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে গ্রামের গর্ভবতীরা। গ্রামের গর্ভবতীকালীন স্বাস্থ্যসেবা পান না ৬৪ শতাংশ গর্ভবতী ও শহরে ৪৩ শতাংশ। তবে ২ শতাংশ নারী এখনো একবারের জন্যও এই সেবা নেয়নি। যদিও বাসাবাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীদের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার ৯ শতাংশ কমেছে। কিন্তু এখনো মোট প্রসবের ৩৬ শতাংশই হচ্ছে বাসাবাড়িতে অনিরাপদভাবে। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বাসাবাড়িতে সন্তান প্রসব হচ্ছে ১৪ শতাংশ বেশি। গ্রামাঞ্চলে মোট প্রসবের ৩৬ শতাংশই হচ্ছে বাসাবাড়িতে ও শহরাঞ্চলে ২২ শতাংশ। এছাড়া নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি বাল্যবিবাহ বেড়েছে। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে বিবাহের হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে এই হার ৯ শতাংশ ও শহরে ৭ শতাংশ। অন্যদিকে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় ৪২ শতাংশ নারীর। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৪১ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে এই হার ৪৪ শতাংশ ও শহরে ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সন্তান প্রসব হচ্ছে ২৬ শতাংশ মায়ের, যা বাসা-বাড়িতে প্রসবের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবের হার ১০ শতাংশ বেশি। গ্রামে ২৪ শতাংশ মা ও শহরে ৩৪ শতাংশ মায়ের সন্তান প্রসব হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ ২৮ মে দেশে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও দিবসটি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হবে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘মাতৃস্বাস্থ্যের সমতা, বাদ যাবে না কোন মা’। নিরাপদ মাতৃত্ব ও নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস সরকার পালন করে আসছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের প্রান্তিকের মায়েরা পরিকল্পিত গর্ভধারণ করছে না। গর্ভধারণের আগে কোনো চিকিৎসকের কাছে তারা যান না; শরীরে আগে থেকেই কোনো রোগ আছে কি না, তা না জেনেই তারা গর্ভধারণ করেন আমাদের দেশের নারীরা। তিনি হয়তো ইতিমধ্যে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তার হয়তো থাইরয়েড আছে, ডায়াবেটিস আছে, কিংবা তার অধিক ওজন আছে, এ ধরনের সমস্যা নিয়েই গর্ভধারণ করছে। তারা প্রসব পূর্ব চার বার সেবা নিতে আসেন না। ফলে ঐ প্রসূতির সন্তান কী অবস্থায় আছে তা জানা যায় না, এভাবে ঝুঁকিগুলো তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, এরপর গর্ভধারণের চার থেকে ছয় বার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার কথা—এই কাজটাও তারা এখনো করছে না। ফলে, উচ্চঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী যারা, যাদের নিজের ও সন্তানের ঝুঁকি থাকে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশে ৫৪ শতাংশ মাতৃমৃত্যু হয় বাড়িতে, আর ৪৬ শতাংশ মৃত্যু হয় হাসপাতালে। বাড়িতে প্রসূতি মৃত্যুটা একটা অপমৃত্যু। মাতৃমৃত্যু যে বাড়িতে হবে, সেই বাড়িতে তদন্ত হওয়া দরকার, নইলে কমিউনিটি ক্লিনিক ঘরে ঘরে দিলেও যতদিন এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া না হবে, ততদিন প্রতি বাড়িতে ক্লিনিক দিয়েও লাভ হবে না। একটা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র্র থেকে যখন জটিলতার কারণে জেলা শহরে রোগীকে রেফার্ড করা হয়, তখন সেই সেবাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের দায়িত্ব নেওয়া হয় না।

ইত্তেফাক/এমএএম