ইসরায়েলি অবরোধ আর চারিদিকে ট্যাঙ্কের আওয়াজের মধ্যে দুই মাস আটকে থাকার পর, ফিলিস্তিনি নারী আজিজা বোমার আঘাতে নিহত তার স্বামীকে নিজ হাতে কবর দিয়েছেন। যুদ্ধে বিধ্বস্ত গাজায় কাফনের কাপড় নেই, কারো সহায়তা নেই, তার একমাত্র অবলম্বন ছিলো জানালার পর্দা ও দৃঢ় সংকল্প। গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খিরবেত আল-আদাসে এই বেদনাদায়ক মানবিক দৃশ্য আজ বিশ্ব বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
৭০ বছর বয়সী ইব্রাহিম ছিলেন আজিজার স্বামী, একসঙ্গে তারা কাটিয়েছেন ৫০ বছরের বেশি সময়। মার্চে রাফাহে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের সময় তিনি আহত হন এবং পরে মারা যান। তার মৃত্যুর পর, পরিবার পরিজন ছাড়া আজিজা তার স্বামীকে একা হাতে কবর দেন একটি জলপাই গাছের নিচে। তবে আজিজার স্বামীর কপালে জুটেনি কোনো কাফনের কাফন, ছিল শুধু এক টুকরো জানালার কাপড়।
দুই মাসের বন্দিত্ব জীবন
এই বছরের মার্চে ইসরায়েল গাজার রাফাহ অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালিয়ে পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করে ফেলে। সেই সময় আজিজা ও ইব্রাহিম তাদের বাড়িতে আটকা পড়ে যান। চারপাশে গোলাগুলি, ট্যাঙ্ক ও যুদ্ধবিমানের শব্দ, খাদ্য ও পানির তীব্র সংকট সব মিলিয়ে মৃত্যুর ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায় তাদের জীবন।
আজিজার স্বামী অন্ধ ছিলেন, একা চলাফেরা করতে পারতেন না। আজিজা তার স্বামীকে কথা দিয়েছিলেন তিনি তাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না। আজিজা বলেন, ‘৫০ বছর তোমার সঙ্গে ছিলাম, কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।’
যুদ্ধ শুরুর পর তাদের কাছে থাকা সামান্য একটু খাবার নিয়ে দুই মাস তারা বেঁচে ছিলেন। কাছের একটি পরিত্যক্ত ভবন থেকে আজিজা সামান্য পানি সংগ্রহ করে আনতেন। তাই দিয়ে তার অন্ধ স্বামী ও সে দিন পার করতো। এই পুরো সময়টিতে তারা কখনো বাইরে বের হতো না। আজিজা বলেন, আমি তাকে একা ছেড়ে বাইরে গেলেই সে ভয় পেতো। প্রতিবেশীরা সবাই পালিয়ে গেলেও আজিজা তার অন্ধ স্বামীর কাছে ছিলেন শেষ পর্যন্ত।
প্রাণপণ চেষ্টা, নিঃসঙ্গ মৃত্যু
দীর্ঘ দু’মাস একসঙ্গে নি:সঙ্গ দিন কাটানোর পর একদিন হঠাৎ করে ইসরায়েলি বাহিনীর একটি বোমার আঘাতে তাদের বাড়ির একটি অংশ ধসে পড়ে। সেই মুহূর্তে আজিজা দেখতে পান, তার স্বামীর ঘাড় দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তিনি তাকে বাঁচিয়ে রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করেন। অ্যান্টিসেপটিক দেন, পানি দেন, জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু তখন তাদের সহায়তা করার মতো কেউ ছিল না।
স্বামীকে পিঠে তুলে নিয়ে পাঁচ ঘণ্টা হাঁটেন আজিজা। চেষ্টা করেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ক্লান্ত আজিজা স্বামীকে একা বাঁচাতে ব্যর্থ হন। অবশেষে, ইব্রাহিম মারা যান। মৃত্যুর আগে আজিজার কাছে ইব্রাহীম একটু পানি চেয়ে বলেন, ‘আমার মুখে ও মাথায় একটু পানি দাও।’ তারপরই মৃত্যুর কোলে ঢেলে পরেন তিনি।
ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর আজিজা নিজ হাতে তাকে দাফন করেন। কোথায় দাফন করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। খুঁজতে খুঁজতে বাগানে একটি পুরনো গর্ত খুঁজে পান। জানালার পর্দায় জড়িয়ে, তার স্বামীকে সেখানে নিয়ে গিয়ে প্রথমে দস্তার চাদর, কাঠ, তারপর মাটি দিয়ে কবর দেন। তিনি কবরের পাশে বসে সূরা ইয়াসিন ও আয়াতুল কুরসি পাঠ করেন। আজিজা বলেন, ‘তাকে কবর দেওয়ার সময় আমি নীরবে কাঁদছিলাম।’
কিন্তু দুঃস্বপ্ন তখনও শেষ হয়নি। ১৪ দিন পর, তিনি দেখতে পান এবার কবরটি বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপর থেকে মাটি সরে গিয়েছে। এরপর তিনি আবার নিজের হাতে তার স্বামীর মাথা কবরের ভিতর রেখে আরও গভীর করে গর্ত করেন, নতুন কাঠ ও দস্তা দিয়ে আরও মজবুত করে দেন।
অবশেষে দু’মাস স্বামীকে নিয়ে একা থাকার পর ২৪ মে, খাবার ও পানি শেষ হয়ে গেলে আজিজা বাধ্য হন ঘর ছেড়ে বের হতে। এক কাপড়ে, একটি লাঠি, আর দুটি ব্যাগ নিয়ে তিনি হাঁটা শুরু করেন। সামরিক চেকপয়েন্টে ইসরায়েলি সেনারা তাকে থামায়। হিজাব খুলতে বললে, প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও পরে বাধ্য হন খুলতে।
‘২০ জন সৈন্য বন্দুক তাক করেছিল,’ বলেন তিনি। ‘ভয় পেয়ে নয়, ক্লান্তি আর দুর্বলতা আমাকে বাধ্য করেছিল।’ তাকে একটি জিপে তুলে কিছু প্রশ্ন করা হয়। তারপর তাকে রাফাহ থেকে খান ইউনিসের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পথে কিছু পরিচিত মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তরুণরা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অবশেষে আজিজা পৌঁছান একটি অস্থায়ী শিবিরে, যেখানে তার পরিবারের সঙ্গে তার পুনরায় মিলন হয়। এই পুরো সময়টিতে তার একটিও অভিযোগ নেই, নেই কষ্টের জন্য আক্ষেপ। তিনি শুধু বলেন, ‘আমার ইব্রাহীমকে মনে পরছে।’
আজিজার এই অভিজ্ঞতা শুধু একজন নারীর অসীম সাহসিকতার গল্প নয়, এটি গাজার অসংখ্য নারী-পুরুষের প্রতীক, যারা যুদ্ধের মাঝেও নিজের সঙ্গিকে বাচিয়ে রাখতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে। সহিংসতা, মৃত্যু আর অবরোধে আটকে থেকেও যাদের মমতা, সেবা ও আত্মত্যাগ হারিয়ে যায় না। ‘আমার কোনো ভয় নেই,’ বলেন আজিজা। ‘যা হয়েছে, তা আমি আল্লাহর জন্য করেছি।’
আজিজার এই জীবনের গল্প আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা আর মানবতার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে। আজিজার মতো মানুষরা যেন শান্তির আহ্বান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে। তথ্যসূত্র: মিডেল ইস্ট আই