রোববার, ২০ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

থমকে আছে ৬৬৫ মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ

শ্রেণিকক্ষ সংকটে পাঠদান ব্যাহত লাখো শিক্ষার্থীর

আপডেট : ১১ জুন ২০২৫, ০৪:০০

থমকে আছে ৬৬৫ মাদ্রাসা ভবন নির্মাণকাজ। তিন বছরের কাজ সাত বছরেও সম্পন্ন না হওয়ায় এই দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষ সংকটে স্বাভাবিক পাঠদান ব্যাহত হয়েছে লাখো শিক্ষার্থীরা। কোথাও কোথাও খোলা আকাশের নিচে ক্লাস হচ্ছে। সূর্য যখন অসহনীয় তাপ দিচ্ছে তখন ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা রোদে পুড়ে ঘেমে অস্থির হচ্ছেন। আর ঝড়-বৃষ্টি হলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্লাস। এমন অবস্থার মধ্যে নতুন করে হতাশার খবর হলো গত ১০ মাস ধরে খোঁজ মিলছে না মাদ্রাসা ভবন নির্মাণে পাঁচ শতাধিক ঠিকাদারের।

জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর থেকেই ঠিকাদারদের কেউ দেশে আত্মগোপনে, আবার কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এতে বিপাকে পড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)। প্রসঙ্গত, নির্মাণকাজের দায়িত্বে থাকা অধিকাংশ ঠিকাদার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। ৬৬৫ মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী আছে প্রায় ২ লাখ। 

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৬ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকার ‘নির্বাচিত মাদ্রাসাসমূহের উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে ১ হাজার ৮০০ মাদ্রাসার। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। ১ হাজার ১৩৫টি মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ৫১৩টি বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। এগুলোর ইতিমধ্যে দুই দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তৃতীয় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধি হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে ১৫২ মাদ্রাসা ভবন নির্মাণকাজ এক শতাংশও সম্পন্ন হয়নি। এ কারণে এসব মাদ্রাসার উন্নয়নকাজ সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেই বৃদ্ধি পায় কাজের দর। লাভ হয় ঠিকাদারের। গচ্চা যায় সরকারের টাকা। অধিক মুনাফার লোভে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কৌশলে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে থাকে। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজসের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, গত ৫ আগস্টের পর একাধিক ঠিকাদার আত্মীয় দিয়ে কাজ শেষ করছেন। অনেকে আবার স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে উন্নয়নকাজ দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও এখন পর্যন্ত এক চতুর্থাংশ ঠিকাদার লাপাত্তা। ফলে আগের কাজ বাদ দিয়ে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিছু কাজের দরপত্রও সম্পন্ন হয়েছে।

সৈয়দপুরে পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি মাদ্রাসা ভবনের কাজ, মাঠে পাঠদান : নীলফামারীর সৈয়দপুরের কুমারগাড়ী দাখিল মাদ্রাসার চারতলা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের জুন মাসে। শেষ হওয়ার কথা পরের বছর ডিসেম্বরে। কিন্তু পাঁচ বছরেও কাজ শেষ হয়নি। তিন দফা বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। এরপরও ২৫ শতাংশ কাজ বাকি রেখে ঠিকাদার ৮০ শতাংশ বিল তুলে নিয়েছে বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আর খোঁজ মিলছে না ঠিকাদারের। তিনি গা ঢাকা দেওয়ায় নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। এদিকে শ্রেণিকক্ষ সংকটে বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে খেলার মাঠে চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। মাদ্রাসা ও নীলফামারী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শ্রেণিকক্ষ সংকট দূর করতে ১২ কক্ষবিশিষ্ট চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৬ লাখ ৫ হাজার ৫১৩ টাকা ১৯ পয়সা বরাদ্দ দেওয়া হয়। দরপত্রের মাধ্যমে কাজটি পায় দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মোহাম্মদ শাহ আলমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড জিন্নাত আলী জিন্নাহ (জেভি)। কাজ শুরু হয় একই বছরের ১৭ জুন। চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এরপর নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার অজুহাতে ২০২১ সাল থেকে তিন বছর কাজ বন্ধ রাখে। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে পুনরায় কাজ শুরু করার তিন মাসের মাথায় আবারও কাজ বন্ধ করে দেয়। ২৫ শতাংশ বাকি থাকলেও বর্তমানে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। শিক্ষার্থীরা জানায়, বেশির ভাগ সময় তাদের খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করতে হয়। খরা ও বৃষ্টিতে দুর্ভোগে পড়তে হয়। 

মাদ্রাসা সুপার মোছা. ফেরদৌসী বেগম সাংবাদিকদের বলেন, বারবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তারা নির্মাণকাজ শেষ করছে না। এ ব্যাপারে আমরা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর নীলফামারীর প্রধান প্রকৌশলী বরাবর কয়েক বার চিঠি দিয়েছি। এরপরও কাজ শেষ করতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকায় মাদ্রাসার কার্যক্রম বন্ধ থাকলে সেখানে এলাকার কিছু মাদকসেবী মাদকের আড্ডা বসায়। এছাড়া নানা অসামাজিক কাজ করে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ পর্যন্ত ভবনটির ৭৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ঐ ঠিকাদারকে ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরপর তিন দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ করতে পারেনি। এ বিষয়ে আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বললে তারা চলতি জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা জানায়। কিন্তু এরমধ্যে হঠাৎ করেই কাজ বন্ধ করে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। মোবাইল ফোনেও যোগাযোগের চেষ্টা করে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। জুনের মধ্যে কাজ শেষ না হলে চুক্তি বাতিল করে অবশিষ্ট কাজের জন্য আবার দরপত্র দিয়ে কাজটি শেষ করা হবে।

ইত্তেফাক/এমএএম