‘আমার শরীরে হাফ হাতা গেঞ্জি ছিল, কলারওয়ালা। সেটা মাথার ওপর দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিয়ে মুখের ওপর অনবরত ঘুষি মারছিল, দাঁতে লেগে ওপরের ঠোঁটটা আমার কেটে গেছিল। তাৎক্ষণিক পায়ে দুটি ক্লিপ লাগিয়ে দিল। ফার্স্ট সেবার শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা। মনে হচ্ছে যখন শক দেয়, টোটাল শরীরটা আমার ফুটবলের মতো গোল হয়ে যায়। এ রকম আট-১০ বার মেবি আমাকে শক দিছে। শকটা হয়তো তিন-চার সেকেন্ড সর্বোচ্চ থাকে। তাৎক্ষণিক শরীরটা গোল হয়ে যায়, সব রগগুলো চেপে ধরে। তো ঐ প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়। খুবই বেপরোয়াভাবে চার-পাঁচ জন পিটানো শুরু করল, দুই হাত ধরে ঐ হুকের ওপর লাগায় দিয়ে। মনে হচ্ছে হয়তো কিছুতে সুইচ টিপছে, অটোমেটিক আমার শরীরটা ওপরে উঠে যাচ্ছে। সে মুহূর্তে আমার কাপড় খুলে, আবার ঐ একই ক্লিপ লাগিয়ে দেয় আমার গোপন দুটি অঙ্গে এবং ঐ জিজ্ঞাসাবাদ সেম চলতে থাকে।’
‘যখনই সুইচ দেয়, আমার মনে হয়েছে যে, আমার সে অঙ্গগুলো পুড়ে যাচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে আমি গোস্ত পুড়লে যে রকম একটা গন্ধ লাগে, সেই গন্ধটা পাইতাম আর কি। চার থেকে পাঁচ জন টোটাল বডিতে আমার পা থেকে একেবারে গলা পর্যন্ত পিটাত। গরু পিটানের মতো, সবদিক দিয়ে। মানে, কোনো জায়গাতে আমার ফাঁকা ছিল না।’
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের ওপর কীভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো, সে বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে। গত ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ :আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের ঐ প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিটি বাহিনীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের টর্চার সেলে কীভাবে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো তার বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) ঢাকা সেনানিবাসের মধ্যে অবস্থিত যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র। এটিই ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত। এই স্থানটি দেশের সবচেয়ে কুখ্যাত আটক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি, যা ব্যাপক নির্যাতন এবং দীর্ঘস্থায়ী গোপন আটকের জন্য পরিচিত। আয়নাঘরে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক বিরোধীরা এবং সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেমন ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ আমান আজমী, রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান, হুম্মাম কাদের চৌধুরী এবং মাইকেল চাকমাসহ শত শত অখ্যাত ব্যক্তি।
ডিজিএফআইয়ের অপারেশনাল ক্ষমতার কারণে, অপহরণ পরিচালনার সময় অপারেশনাল সহায়তার জন্য এটি প্রায়শই র্যাব ইন্টেলিজেন্সের ওপর নির্ভর করত। জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতনের পর আটক ব্যক্তিদের র্যাবে ফিরিয়ে দেওয়া হতো অথবা গোয়েন্দা শাখায় স্থানান্তর করা হতো, যেখানে অনেককে পরবর্তীতে বিচারবহির্ভূতভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো অথবা দীর্ঘ সময় ধরে মিথ্যা অভিযোগে আটক রাখা হতো। আয়নাঘর সম্পূর্ণরূপে ডিজিএফআইয়ের অধীনে নিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হতো। এতে একাধিক ‘জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ’ ছিল, যেখানে আটককৃতদের মারধর, ছাদ থেকে ঝুলানো, বিদ্যুৎ শক দেওয়া এবং ঘোরানো চেয়ারের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে নির্যাতন করা হতো। জোরে জোরে এগজস্ট ফ্যান শব্দকে ঢেকে রাখত এবং ভুক্তভোগীদের চোখ বেঁধে এবং দীর্ঘ সময় ধরে শেকল দিয়ে আটক রাখা হতো।
আয়নাঘর থেকে উদ্ধার হওয়া একজন ভিকটিম ইলেকট্রিক শক দেওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গুম কমিশনকে বলেন, ‘আরেক দিন রিমান্ডে নিয়ে গেল। তখন রাত ১২টা বাজে। ঐ সময় ইলেকট্রিক শক দিল। কানের মধ্যে দুটি ক্লিপ দিয়ে ইলেকট্রিক শক দিতে থাকল। তারপর আমাকে বলল যে, তোকে তো অনেক পিটাইলাম, মারলাম। কিন্তু তুই তো কিছু বললি না। অমুকরে তো তুই ভালো করেই চিনিস। তাহলে অমুকে তোকে এসব কাজে আনছে।’ একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফেরার পর শুনতে পাই, ‘তুই তো অনেক মেধাবী, তোর মেধাটা কিছু কমাই দিই।’ তখন কানের মাঝে ক্লিপ লাগিয়ে দিয়ে শক দিত। পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যেত। সাথে সাথেই মনে হইতো যেন আমি শেষ। আমি চোখে ঝাপসা দেখতাম। এভাবে আর কি, দিনের পর দিন শাস্তি দিত।’