রোববার, ২০ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস আজ

জুলাই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী শিশুদের সঠিক তথ্য নেই

আপডেট : ১২ জুন ২০২৫, ০৫:০০

১৭ বছর বয়সী মো. হাসান। তিন চার বছর আগে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে। পশ্চিম জুরাইনের বাসিন্দা হাসান একটি প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করত। ৫ আগস্ট বেলা ১২টার সময় আন্দোলনরত অবস্থায় সে পায়ে গুলি খায়। তার একটি অস্ত্রোপচার হয়। হাসানের বাবা মো. আব্দুল মজিদ একজন রিকশাচালক। এক পায়ে ভর করে চলা হাসানের বাবার প্রশ্ন—ছেলেটার ভবিষ্যৎ কী?

এমন প্রশ্ন শুধু হাসানের বাবার নয়, আন্দোলনে আহত শ্রমজীবী পরিবারগুলোর। হাসান জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)-এ সে চিকিৎসা নেয়। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, জুলাই আন্দোলনে আহতদের মধ্যে আছে অনেক শিশু শ্রমিক, যারা দারিদ্র্যের কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে আগেই। জুলাই আন্দোলন তাদের ক্ষতবিক্ষত করে স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু তাদের সঠিক পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত নেই সেভাবে। বিজ্ঞজনেরা বলছেন, তাদের দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন জরুরি, যাতে শৈশবের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না পারলেও তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে, পরিবার তাদের বোঝা না ভাবে।

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে জানা যায়, এখনো অনেকের তথ্য তাদের কাছে নেই। শ্রমজীবী শিশুদের তালিকা আলাদা করা হয়নি। তাদের তথ্য সংগ্রহ ও পুনর্বাসনের কাজ চলমান—এমন বাস্তবতার মধ্যে আজ ১২ জুন ‘স্বপ্নের ডানায় ভর করি, শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ছিঁড়ি, এগিয়ে চলি দৃপ্ত পায়ে, আশার আগুন বুকে জ্বলে’ প্রতিপাদ্য করে দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। ঈদের ছুটি থাকায় সরকারিভাবে ১৯ জুন দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী শিশু শ্রমিকরা

১৩ বছরের সাথী খিলগাঁও এলাকায় রাস্তায় থাকে, পানি-ফুল বিক্রি করে। আন্দোলনে সে গুলি খায়। বলে, ‘আমার শরীর বর্তমানে ভালা। আন্দোলনের সময় একটা আপুকে মারার সময় আমি তাকে বাঁচাই। আপুকে ওপর থেকে গুলি মারে আমার গায়েও লাগে‌। পুলিশ আমাকে মেরেছে। অন্য একটা আপু আমাকে বাঁচিয়েছে। আমি দুই দিন দিন হসপিটালে ছিলাম।’ ১৫ বছরের সালমান হোসেন মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় বাস করে। বাবা-মাও রাস্তায় থাকে। সালমান এমনিই বোতল টোকায় ভাঙারি বিক্রি করে। বলে, ‘আমি যেদিন আন্দোলনে ছিলাম, সেই দিন পুলিশ আমারে লাঠি মারে। আমি এক ভাইরে ধাক্কা দিয়া পালাই। ঐ ভাইরে পড়ে গুলি করে মেরে ফেলে। আমার গায়েও রাবার বুলেট মারে। আন্দোলনের সময় আমার ক্ষতি হয়, আমার শরীর পুড়ে যায়। আমার অনেক কষ্টে দিন কেটেছে।’ ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মাসুদ আলী বলেন, ‘প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে শিশুরা ক্ষতির শিকার হয়েছে। তাদের ক্ষতিপূরণ নয়, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন জরুরি। আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী শিশুদের জন্য আলাদা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এখনো তাদের তথ্য সংগ্রহ না করলে তথ্য হারিয়ে যাবে।’

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে নেই শ্রমজীবী শিশুদের তথ্য

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৪৩৩ জন আহত ও ১৩১ জন নিহত হওয়া শিশুর তথ্য সংগ্রহ করেছে। তবে শ্রমজীবী শিশুর তথ্য তাদের কাছে নেই। সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল আকবর জানান, মেডিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) থেকে তারা এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তারা কয়েক দফা নিহত ও আহতদের সহযোগিতা করেছেন। নিহত শিশুদের পরিবারকে ৫ লাখ ও আহতদের প্রথম ধাপে ১ লাখ টাকা করে অর্থ সহযোগিতা করা হয়েছে। তবে অনেক বেশি নয়। তিনি বলেন, অনেক শিশু, শ্রমজীবী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেনি। তাদের কাছে নেই সেই তথ্য। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাদের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম ও সহযোগিতা প্রদান কার্যক্রম চলমান।

দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন জরুরি

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে—জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৮৩৪ জন শহিদ এবং ১২ হাজার ৪৪ জন আহত হয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাবে—নিহত মানুষের মধ্যে ১৩২ জনই শিশু-কিশোর। জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—এ সময় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারেন। নিহত ব্যক্তিদের ১২ থেকে ১৩ শতাংশই শিশু। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিপূরণের ওপর জোর দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ—বিলস নির্বাহী পরিচালক ও শ্রম সংস্কার কমিশন প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। তিনি বলেন, ‘বাজেটে কিছু বরাদ্দ দিয়ে হবে না। যেসব শিশু শ্রমিকের তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের পরিবারকে এখনই পুনর্বাসনের আওতায় আনতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবারগুলো শিশুর আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আর যেসব শিশু প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়েছে, তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহযোগিতা করে কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। দারিদ্র্যের কারণে তারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছে, এই আন্দোলন তাদের শারীরিক মানসিক ক্ষতি করেছে, তা আমাদের কোনোভাবে ভুলে গেলে চলবে না। শ্রমজীবী এই শিশুদের দীর্ঘ জীবন পরে আছে।’ এদের জন্য সেমিনার সিম্পোজিয়াম নয়, তারা যেন একটি স্বস্তি জীবন পায়, সে টার্গেট নিয়ে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

ইত্তেফাক/এমএএম