শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

 গুম কমিশনের দ্বিতীয় তদন্ত প্রতিবেদন

‘ম্যাডাম জিয়ার টাকা কোথায় দিয়েছেন?’

আপডেট : ১৩ জুন ২০২৫, ০৭:৩১

তখন মনে আছে, একটা হাতুড়ি দিয়ে জোরে বাড়ি মেরেছে আমার হাঁটুর মধ্যে। আমার তখন গলায় আওয়াজ আটকে গেছে পুরা। মানে এত জোরে লেগেছে, আমি তখন আর কথা বলতে পারছিলাম না। তো পাশ থেকে আরেক জন ইয়াং অফিসার তখন চিল্লাচ্ছে, ‘স্যার, একে শেষ করে ফেলি। এই করে ফেলি, ওই করে ফেলি।’

তো অন্যজন বলছে, ‘না, মুখ খুলবে। কয়দিন বন্ধ রাখবে?’ এরপরে একজন বলল, ‘তারেক রহমানের একাউন্ট ডিটেইল বলেন। কোন কোন জায়গায় তার টাকা থাকে।’ আমি বললাম, ‘ভাই, আমি জানি না। ডোন্ট নো। সিম্পলি ডোন্ট নো।’ তখন বলছে, ম্যাডাম জিয়ার টাকা কোথায় দিয়েছেন? কোথায় রাখেন?’ এই বলে হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে থাকে।

গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে। ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের ঐ প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিটি বাহিনীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে গুম থেকে ফিরে আসা সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানের সাক্ষাত্কার স্থান পেয়েছে।

মারুফ জামান ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর বিদেশ যাওয়ার পথে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিখোঁজ হন। তার নিখোঁজ হওয়ার কয়েক দিন পর তিন লোক ধানমন্ডির বাসা থেকে মারুফ জামানের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ বেশকিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এরপর নিখোঁজ থাকার ১৬ মাস পর ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ রাতে ধানমন্ডির বাসায় ফিরে আসেন। মারুফ জামান ১৯৭৩ সালে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার সেনাকর্মকর্তা থাকা অবস্থায় তিনি পররাষ্ট্র ক্যাডারে আত্মীকরণ হন। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উইংয়ে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ কাতার ও ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৫ সাল থেকে অবসর জীবন যাপন করছিলেন।

গুম কমিশনের তদন্ত রিপোর্টে সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানকে ডিজিএফআইয়ের জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে (জেআইসি) নিয়ে আটক করে রাখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ডিজিএফআইয়ের জেআইসিতে আটক থাকা সাবেক রাষ্ট্রদূতকে সামরিক কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। হাতুড়ি পেটা করা হয়। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূতের যোগাযোগ থাকার বিষয়ে তথ্য জানতে চায় জেআইসির সামরিক কর্মকর্তারা।

জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে এক সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ‘আচ্ছা, আপনার সাথে তো ওইদিন এই কথা হয়েছিল। আপনি কি এখন রেডি বলার জন্য?’ আমি বললাম, ‘আমি কিছু জানি না।’ তো বলছে, ‘আপনি আমাদেরকে আগে বলেন, আপনি বেগম খালেদা জিয়ার জন্য কি করতেন?’ আমি বললাম, আমি শুধু পার্টি করি। আমাকে যখন যে টাকাটা দেওয়া হয়, আমি সেটা ফলো করি। ওরা জিজ্ঞেস করছে, ‘উনার সেফটি সিকিউরিটিতে কোন কোন দেশ ইনভলভ? কারা তাকে সহযোগিতা করে?’

আমি বলেছি, ‘আমি জানি না। তো যখন বলছি জানি না, তখন বলল যে, ‘দেখেন, আপনি যত আমাদের সাথে নন কোঅপারেশন করবেন, আপনার জন্য দিন তত খারাপ হবে।’ তখন ওই ব্যক্তি বলল যে, ‘আপনি অ্যাম্বাসিতে যেতেন। অ্যাম্বাসি থেকে গিফট আসতো। উনি গিফট দিত। এসব গিফটে কি ছিল?’ আমি বললাম, ‘আমি জানি না।’ তখন মনে আছে, একটা জোরে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারল আমার হাঁটুতে। তখন আমার গলায় আওয়াজ আটকে গেছে। মানে এত জোরে লেগেছে, আমি তখন আর কথা বলতে পারছিলাম না।

ইত্তেফাক/এএম