বায়ুর নানাবিধ দূষণের শিকার শিশুরা। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা বায়ুদূষণজনিত রোগের বেশি শিকার হয়ে থাকে। এর প্রভাবে অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ, হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার দেখা দেয়। শ্বাসনালীর সংক্রমণে পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার ৪০ শতাংশের জন্যই দায়ী বায়ুদূষণ। আর ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১৯ হাজারেরও বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২১ সালে বায়ুদূষণ সম্পর্কিত কারণে বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী ৭ লাখের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। সারা বিশ্বে এই বয়সী শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারণ ‘অপুষ্টির’ পরই রয়েছে ‘বায়ুদূষণ’, যা শিশু মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, বায়ুর নানাবিধ দূষণ রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস, হেভিমেটাল বা ভারী ধাতব পদার্থ এবং কার্বনডাই অক্সাইডসহ অনেক কিছু রয়েছে। শিশুরা যখন সেটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে, তখন তাদের প্রথমত শ্বাসতন্ত্রীয় সমস্যা তৈরি হয়। হাঁচি, কাশি, ঠাণ্ডা, নিউমোনিয়া শুরু হয়। এই দূষণ শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। অন্য দিকে হৃদপিণ্ডের কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের আউট ডোরে এই প্রতিবেদকের কথা হয় শিশুর চিকিৎসা নিতে আসা চায়না আক্তারের সঙ্গে। এই নারী বলেন, আমার সন্তান ওর বয়সী অন্য বাচ্চাদের চেয়ে অনেক ছোট, দুর্বল এবং বেশি খেতে পারে না। টানা সর্দি লেগেই থাকে। তার রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসক বেশকিছু পরীক্ষানিরীক্ষা দিয়েছেন। নুহার বয়স পাঁচ বছর হলেও তাকে দেখতে দুই বছরের বাচ্চার মতো লাগে।
গত বছর প্রকাশিত স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের (এসওজিএ) ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্ব-পশ্চিম, মধ্য এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার দেশগুলোতে বায়ুদূষণজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। শুধু ২০২১ সালেই বাংলাদেশে ২ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যুর কারণ ছিল এই বায়ুদূষণ, যা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা বায়ুদূষণজনিত রোগের বেশি শিকার হয়ে থাকে, এর প্রভাবে অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ, হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশসহ আফ্রিকা এবং এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে, লোয়ার-রেসপাইরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণে পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার ৪০ শতাংশের জন্যই দায়ী বায়ুদূষণ। ২০২১ সালে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১৯ হাজারেরও বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের রিপ্রেজেন্টেটিভ শেলডন ইয়েট বলেছেন, লাখ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দূষিত বাতাসের ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের ওপরই বেশি দেখা যায়, এর প্রভাবে তারা হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়। বর্তমান কেবল নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও বাতাসের গুণমান উন্নত করতে টেকসই সমাধান বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বে যত হার্ট অ্যাটাক হয়, তার ২৫ শতাংশ বায়ূদূষণজনিত কারণে হয়। সেই হিসেবে আমরা শিশুদের মধ্যেও এখন হার্ট অ্যাটাকের হার বেশি দেখছি। সেখানেও বায়ুদূষণের একটা প্রভাব রয়েছে বলে আমরা মনে করি। এর বাইরে শিশুর যে মেটাবলিক প্রসেস, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হরমনের সমস্যা তৈরি হয়। নারী ও পুরুষ শিশুর জননেন্দ্রিয়ে একটা প্রভাব ফেলে। ফলে পরবর্তীতে সন্তান জন্মদিতে নারী ও পুরুষ উভয়ের সমস্যা হয় বা বন্ধাত্ব তৈরি হয়। এর বাইরে স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ কমে যাওয়ার কারণে মনোযোগে অসুবিধা অথবা দ্রুত রগচটা হয়ে যায়, হিংস্র প্রকৃতির আচরণ তৈরি হয়, সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, একজন মানুষের শরীরে যত ধরনের রোগ হয় তার সবকিছুর সঙ্গেই বায়ুদূষণের যোগ রয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চাইলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।