চলতি মৌসুমে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে আমের ফলন ভালো হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে সব জেলায় সব জাতের আম বাজারে চলে আসায় বিপাকে পড়েছেন চাষি, ব্যবসায়ীরা। অতিরিক্ত গরম, ঈদের দীর্ঘ ছুটির আমেজ ও বাজারে পাইকারি ব্যবসায়ীর অনুপস্থিতি, বাজারে আমের দামে ধস নেমেছে। এতে করে আম চাষি ও মৌসুমি বাগান ব্যবসায়ীরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের মোকাম পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ওসমান আলী আমচাষি, বাগান ব্যবসায়ী ও মোকাম আড়তদারদের বরাত দিয়ে জানান, অতিরিক্ত গরমে একসঙ্গে পেকে বাজারে এসেছে বিভিন্ন জাতের আম। ফলে চাষিরা গাছে আম রাখতে পারছেন না। সব জেলায় সব জাতের আম একসঙ্গে মোকামে আসায় দাম কমেছে। এছাড়া ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে চালান ও পরিবহণে অচলাবস্থার শিকার হয়েছেন আমচাষিরা। পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে মানুষ ঈদ উদযাপনে গ্রামে চলে যাওয়ায় ক্রেতাসংকটে ব্যবসায়ীরা আমের আড়তে আসছে না।
কৃষি বিভাগ সূত্রমতে, চলতি মৌসুমে দেশে ২৮ লাখ টন আম উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। এর মধ্যে বৃহত্তর রাজশাহীর চার জেলায় ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন (চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪ লাখ ৫৮ হাজার টন, নওগাঁয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার টন, রাজশাহীতে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪৩ টন ও নাটোরে ১ লাখ ৪৩ হাজার টন) আম উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে।
রাজশাহীর হরিয়ানের আমচাষি সাইফুল ইসলাম জানান, ১৫ মে আটি/গুটি, ২২ মে গোপালভোগ, ৩০ মে থেকে ক্ষিরসাপাতি ও ১০ জুন থেকে ল্যাংড়া ও বানানা, ১৫ জুন থেকে আম্রপালি ও ফজলি আম পাড়া শুরুর কথা ছিল। কিন্তু সব আম একসঙ্গে পেকেছে। ল্যাংড়া আম এক সপ্তাহ আগেই বাজারে এসেছে। এমনকি ফজলি আমও আগেই পাকছে। এছাড়া ৫ জুলাই থেকে বারি-৪ জাতের আম আহরণের সময়সীমা থাকলেও ১৩ জুন থেকেই এই জাতের আম বাজারে উঠেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আমচাষি মহসিন আলী বলেন, সাধারণত রাজশাহীর আম আগে পাকে। এর দুই সপ্তাহ পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম পাকে। নওগাঁর আম আরও দুই সপ্তাহ পর পাকে। কিন্তু এবার সব জেলার সব জাতের আম প্রায় একই সঙ্গে পাকছে। ফল গবেষণা কর্মকর্তাদের পরামর্শে শেষ সময়ে কিছু গাছে পানি স্প্রে করা হচ্ছে। এতে বোঁটা শক্ত হলে আরও কিছুদিন গাছে থাকতে পারবে আম। বিশেষ করে যাদের গাছে ফজলি আম আছে, তারা হয়তো কিছুটা দাম পাবেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজারের আড়তদার সাহেব আলী বলেন, ‘এই মুহূর্তে হিমসাগর পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৫০ টাকা মণ দামে, যা কেজিতে পড়ে মাত্র ৪৩ টাকা। গতবার একই সময়ে আমের দাম ছিল অনেক বেশি। এছাড়া ভালো মানের হিমসাগর বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা মণ এবং নিম্নমানের আম ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ। ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। আমচাষিরা বলছেন—ঈদের ছুটি, গরমে আগাম পাকা আম এবং অনলাইন ক্রেতাদের অনুপস্থিতি, সব মিলিয়ে দাম কমেছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত।
নওগাঁয় প্রশাসনের নির্ধারিত সময়ের আগেই বাজারে এসেছে আম্রপালি ও অন্য জাতের আম। ফলে মোকামে আম সরবরাহ কয়েক গুণ বেড়েছে, অথচ তেমন ক্রেতা নেই। নওগাঁয় পাইকারিতে ল্যাংড়া আম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ, আম্রপালি ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা, নাক ফজলি ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই সময় এসব আমের দাম প্রায় দ্বিগুণ ছিল।
নওগাঁর বড় মোকাম সাপাহারের আম বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, এবার সময়ের আগেই আম বাজারে উঠেছে। দাম ঠিকমতো পাওয়া গেছে মাত্র প্রথম চার-পাঁচ দিন। এর পরই শুরু হয়েছে দরপতন। আম চাষিদের দাবি, সরকারিভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ সুবিধা ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে এমন লোকসান এড়ানো যেত।
রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহীর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যমান উচ্চ তাপমাত্রা ও বৃষ্টিহীনতার কারণে আমের ক্ষেত্রে ‘ফোর্স রাইপেনিং’ সিনড্রোম ঘটেছে। বৃষ্টি না থাকায় আমের বোঁটায় থাকা ফ্লুইড শুকিয়ে আপনা-আপনি গাছ থেকে ঝরে পড়ছে আম। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জাতের আম নির্ধারিত টাইম লাইনের দুই সপ্তাহ আগে গাছে পেকে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চাষিরা পাকা আম দ্রুত গাছ থেকে নামিয়ে মোকামে তুলছেন। আমরা জেনেছি এবার মোকামে আমের দাম কিছুটা কম। তবে শিগগিরই বৃষ্টি হলে বিভিন্ন ধরনের আমের স্থায়িত্ব কিছুদিন বাড়বে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. আজিজুর রহমান বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে এবার আমের ফলন বেশ ভালো। তবে তাপপ্রবাহ, অত্যধিক গরম ও বৃষ্টিহীনতার কারণে আম দ্রুত পেকে যাচ্ছে। ঈদের লম্বা ছুটির কারণে আম চালান ও পরিবহণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। ফলে আমের দাম কম। এর পরও ফলন যেহেতু ভালো, সেহেতু চাষিরা ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন।