শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

শুল্ক ফাঁকির সাজানো নাটক ভেস্তে দিলো কাস্টমস

  • তদন্তে ধরা পড়ল নথিপত্রের চাতুর্যপূর্ণ জোড়াতালি
  • মিলল আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক পরিশোধের প্রমাণ
আপডেট : ২২ জুন ২০২৫, ০০:১৫

দেশের বাণিজ্যিক নিরাপত্তা ও শুল্ক আদায়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভূমিকা পালন করছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। কঠোর নজরদারি এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি ও চোরাচালান প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল এ প্রতিষ্ঠানটি। এই নীতির বাস্তব প্রতিফলনও ঘটেছে সম্প্রতি এক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে নেওয়া পদক্ষেপে। 

ভিডিওতে আমদানিকারক ওই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ তোলা হয়। আর এ অভিযোগটি গুরুত্বসহকারে আমলে নেয় ঢাকা কাস্টমস হাউস। প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা কাস্টম হাউস চলতি বছরের মে মাসের ২৪ তারিখে ২-২২/জনপ্রশা./সদর/অভিযোগ/০৮/২০২৪/৬৬১ এক আদেশে জয়েন্ট কমিশনার অব কাস্টমস মুহাম্মদ কামরুল হাসানকে আহ্বায়ক এবং ডেপুটি কমিশনার অব কাস্টমস নেয়ামুল হাসানকে সদস্যসচিব করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্যান্যরা হলেন- জয়েন্ট কমিশনার মো. আল-আমিন, ডেপুটি কমিশনার অব কাস্টমস কানিজ ফারহানা শিমু, রেভিনিউ অফিসার নাহিদ গাজী ও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেভিনিউ অফিসার মো. রাশেদুল ইসলাম।

জানা যায়, একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিও প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে আলোচনায় আসে দেশের অন্যতম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আহসান মতিনা ফুড লিমিটেড। ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, আদার ঘোষণা দিয়ে স্যামন মাছ আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে এবং এতে কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তারাও জড়িত। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তদন্তে প্রতিবেদনে উঠে আসা দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে।

এ ভিডিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- এয়ারওয়ে বিল, বিল অব এন্ট্রি ও কিছু কার্টুন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ‘আদা’ ঘোষণা দিয়ে ‘স্যামন মাছ’ আমদানি করেছে। অন্যদিকে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেভিডিওতে প্রদর্শিত নথিপত্রগুলোর উৎস, সময়কাল এবং পণ্যের ধরণ একে অপরের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উল্লেখ করে বলা হয়- কাস্টমস সদর দপ্তরের আদেশে গঠিত তদন্ত কমিটি সরেজমিনে ভিডিওর প্রতিটি উপাদান যাচাই করেছে। থাইল্যান্ড ও নরওয়ে থেকে আগত পণ্যের এয়ারওয়ে বিল, বিল অব এন্ট্রি, ইনভয়েস এবং প্যাকিং লিস্ট পর্যালোচনায় উঠে আসে- ‘আহসান মতিনা ফুড লি.’ বৈধভাবে আমদানিকৃত পণ্যের যথাযথ শুল্ক পরিশোধ করেই কনসাইনমেন্ট গ্রহণ করেছে। এমনকি যে এয়ারওয়ে বিলকে কেন্দ্র করে মূল অভিযোগ, তাতে স্পষ্টভাবে “Fresh Fruit” লেখা রয়েছে, আদা বা স্যামন মাছ নয়। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বিভ্রান্তিকর ভিডিওটি পরে ইউটিউব থেকে মুছে ফেলা হয়েছে, যা এর অসারতা আরও স্পষ্ট করে।  

তদন্ত কমিটির ভাষ্য- ভিডিওতে যেসব বিল অব এন্ট্রি এবং এয়ারওয়ে বিল দেখানো হয়েছে সেগুলোর অনেকগুলো আহসান মতিনা ফুড লি. -এর নয়, বরং ভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- Vigilance Express Ltd. এর নামে খালাসকৃত কনসাইনমেন্ট। অথচ, ভিডিও নির্মাতারা চাতুর্যের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন চালান এবং কার্টুন নম্বর জোড়াতালি দিয়ে একটি চটকদার মিথ্যা উপস্থাপন করেছেন।

সবশেষে প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি ভবিষ্যতে পচনশীল পণ্য চালানগুলো খালাসে দৈবচয়ন ভিত্তিক পরীক্ষণের পাশাপাশি রিস্ক ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি আরও জোরদার এবং একইসঙ্গে বিভ্রান্তিমূলক ভিডিও ছড়ানো একাউন্টগুলো শনাক্ত করে প্রচলিত আইনের আওতায় আনা উচিত বলে সুপারিশ করেন।

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ডেপুটি কমিশনার অব কাস্টমস মো: নেয়ামুল হাসান বলেন, ‘আমরা ভিডিওতে প্রদর্শিত প্রতিটি নথি ও তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেছি। যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওতে প্রদর্শিত ছবিগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্যচালান থেকে খণ্ড খণ্ড অংশ নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে বানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে বৈধভাবে স্যামন মাছ আমদানি করা হয়েছে এবং প্রযোজ্য শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে খালাস নেয়া হয়েছে; যা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।'

ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার মুহম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিওটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ কাস্টমস এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যেই তৈরি ও প্রকাশ করা হয়েছিল। কারণ, তদন্ত কমিটি গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই ভিডিওটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ফেসবুকসহ অন্য কোথাও সেই ভিডিও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়— ভিডিওটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং এর পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করেছে। 

তিনি আরও বলেন,আমরা এই ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কাজ থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি। যদি কেউ পরবর্তীতে আবারো এ ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইত্তেফাক/এমএএম