শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

গৌরবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৫ বছরে পদার্পণ

বর্ণিল ক্যাম্পাসে দিনব্যাপী নানা আয়োজন

আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৫, ০৭:০০

১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ ১০৫ বছরে পদার্পণ করল। পূর্ববঙ্গের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বঙ্গভঙ্গের ক্ষতিপূরণস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় এক শতকের বেশি সময় ধরে দেশের জ্ঞান, রাজনীতি ও সংস্কৃতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনেরও কেন্দ্রবিন্দু। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার ও সরকার পতন আন্দোলনের সূত্রপাতও হয়েছে এই বিদ্যাপীঠ থেকেই।

২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বিদ্যাপীঠে ইতিবাচক নানা পরিবর্তন এলেও এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভিন্ন কাঠামোগত সংকট, রাজনৈতিক দলীয়করণ, আবাসন সংকট ও প্রশাসনিক অদক্ষতার মতো মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। বিশেষ করে, এ প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে রূপ দেওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তার বাস্তবায়নেও দৃশ্যমান কাজ শুরু হয়নি বিগত সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ১ হাজার ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের মতে, এই বরাদ্দ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

এমন নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সদ্য প্রকাশিত ‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং ২০২৫’-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫৮৪তম। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এটি শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তবে গবেষণায় দুর্বলতা এবং প্রযুক্তিগত পরিকাঠামোর ঘাটতি এখনো আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে প্রধান অন্তরায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান ইত্তেফাককে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের সরকার পতন আন্দোলনসহ প্রতিটি পরিবর্তনের কেন্দ্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল।’

গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করতে চাই। বাজেট বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মানের গবেষক তৈরিসহ গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’ রাজনীতি প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ‘পঠন-পাঠন ও গবেষণাকে রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে রাখতে চাই। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি থাকবে, তবে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে, কোনো বহিঃপ্রভাব নয়।’ উপাচার্য আরও বলেন, ‘আমরা বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করতে চাই, যেখানে বর্ণনির্বিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ায় স্থান  নেবে। বহু মানুষের রক্তের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। দেশের এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দেশপ্রেমিক প্রজন্ম উপহার দিয়ে জাতির দায় এড়াতে চাই।’

এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, ১০৪ বছরের গৌরবময় পথচলার পর এখন সময় এসেছে—একটি মুক্ত, সৃজনশীল এবং গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। তাদের প্রত্যাশা, আধুনিক ল্যাব, মানসম্মত আবাসন, সময়োপযোগী পাঠদান ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হোক। তারা বলছেন, ‘রাজনীতির ভয় নয়, জ্ঞানের আধিপত্য চাই। গেস্টরুম কিংবা গণরুমের পরিবর্তে গ্রন্থাগার হোক আমাদের নির্ভরতার জায়গা।’  প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ বছরের পথচলা কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নয়, এটি একটি জাতির আত্মবিকাশের কাহিনী। এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে এখন যে প্রত্যাশা ধ্বনিত হচ্ছে, তা হচ্ছে, শিক্ষাবান্ধব, বৈষম্যহীন, রাজনীতিমুক্ত, গবেষণাকেন্দ্রিক একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্ণিল ক্যাম্পাস, দিনব্যাপী নানা আয়োজন

১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে উপাচার্য ভবন, কার্জন হল, কলা ভবন ও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কসমূহে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রবেশপথে তোরণ এবং রোড ডিভাইডার ও আইল্যান্ডসমূহে সাজসজ্জা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক, প্রশাসনিক ভবনগুলোও সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে।

‘বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিপাদ্য ধারণ করে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মুখস্থ পায়রা চত্বরে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এরপর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শোভাযাত্রা এবং পর্যায়ক্রমে একাডেমিক ভবন এবং হলসমূহে পতাকা উত্তোলন ও কেক কাটা হবে। এছাড়া সকাল সাড়ে ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলোতে জনসাধারণের চলাচল সীমিত করা হয়েছে জানিয়ে বিকল্প রাস্তা ব্যবহারের জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

দেশ বিনির্মাণে অবদান রাখার প্রত্যাশা প্রধান উপদেষ্টার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী’ উপলক্ষে বাণী প্রদান করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উচ্চশিক্ষার প্রসার, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য ভূমিকা রেখে আসছে। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসহ বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ঐতিহাসিক ভূমিকা সর্বজনবিদিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রতিপাদ্য—‘বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’—অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভবিষ্যতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও দেশ বিনির্মাণে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখবে।’

ইত্তেফাক/এমএএম