বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বিতর্ক এড়াতে চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি থেকে অভিনেত্রী মম’র পদত্যাগ!

আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫, ২০:২১

ছোট ও বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। গত ২৫ মে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন মম। তবে বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে মঙ্গলবার (১ জুলাই) ৩২টি চলচ্চিত্রকে ১৩ কোটি টাকা অনুদান প্রদানের পর।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আওতায় প্রথমবার চলচ্চিত্রে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩২টি চলচ্চিত্রকে মোট ১৩ কোটি টাকা অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ১২টি এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২০টি। প্রত্যেকটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ৭৫ লাখ টাকা এবং প্রত্যেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান দেওয়া হবে ২০ লাখ টাকা। গত ১ জুলাই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

এর আগে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি বাছাই কার্যক্রমের লক্ষ্যে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি’র অন্যতম সদস্য হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম। চলচ্চিত্র ও রাষ্ট্রের উপকারের আশায় তাতে হাসিমুখে সম্মত হয়েছিলেন অভিনেত্রী।

জাকিয়া বারী মম। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু এ বছরের সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্রের তালিকা প্রকাশের পর থেকে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কারণ, খোদ অনুদান কমিটির সদস্যদেরও অনুদান দেওয়ার নজির মিলেছে এবার! এমন ঘটনার ঠিক একদিন পরই নিশ্চিত হওয়া গেলো, উক্ত অনুদান কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন জাকিয়া বারী মম! অভিনেত্রী নিজেই গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

অভিনেত্রী জানান, অনুদানের যে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে ১ জুলাই কিংবা যে সিনেমাগুলো অনুদান পাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের, সেখানে কমিটির সদস্য হিসেবে তার কোনও অংশীদারিত্ব নেই। অর্থাৎ এই নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলো বাছাই ও চূড়ান্তকরণে তার কোনও দায় নেই।

জাকিয়া বারী মম বলেন, ‘আমি পদত্যাগ বেশ আগেই করেছি। ২৫ মে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। জানিয়েছি, ব্যক্তিগত ও পেশাগত কারণে আমি আর এখানে সময় দিতে পারছি না।’

অভিনেত্রী খানিক অস্বস্তি প্রকাশ করে আরও যোগ করেন, ‘ভালোই হলো আপনারা খোঁজ করেছেন। কারণ, অনুদানের প্রজ্ঞাপন জারির পর বেশিরভাগ খবরে আমার নামটাও চলে আসছিলো কমিটির সদস্য হিসেবে। তাছাড়া অনেকেই নানান প্রতিক্রিয়া আমাকে জানাচ্ছিলো, যেহেতু তারা মনে করছিলেন আমি এই কমিটির সদস্য। ফলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া আমার জন্য বেশ অস্বস্তিকর। অথচ আমি এর সঙ্গে নেই গত প্রায় একমাস।’

জাকিয়া বারী মম। ছবি: সংগৃহীত

তবুও প্রশ্ন থাকে, ‘ব্যক্তিগত ও পেশাগত’ ব্যস্ততার উদাহরণ টেনে অব্যাহতি নেয়ার বিষয়টি। কারণ একজন পরীক্ষিত অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম। এ প্রসঙ্গে মম স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘কাজ করার সুযোগ ছিল না। নিয়মের বেড়াজাল। আরেকটু পরিষ্কার করে বলতে গেলে- এই অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কার করে এত পুরাতন নিয়মকানুন সামলে পসিবল হয়ে উঠছিল না। ফলে আগের মতো করেই জিনিসটা আসলে আগাচ্ছিলো। যেখানে আমার কাজ করার আগ্রহটা হারিয়ে ফেলেছি। এখানে আসলে অভিযোগের কিছু নেই। এটা আমাদের সিস্টেমের জটিলতা। সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তো আছেই।’

বলা দরকার, জুলাই বিপ্লবে শিল্পী অধ্যায়ে জাকিয়া বারী মম অন্যতম ফ্রন্টলাইনার ছিলেন। বরাবরই যার ভেতরে ছিলো দেশাত্মবোধ। তিনি ছিলেন সংস্কারের দাবি তোলা অন্যতম অভিনেত্রী। তাহলে সংস্কারের বিপরীতে পুরনো সিস্টেমের কাছেই পরাজিত হলেন মম? শুধুই কি পুরনো আইনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা?

‘দারুচিনি দ্বীপ’খ্যাত অভিনেত্রী’ বললেন, ‘আমি গিয়েছিলাম রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে। সেটা পারিনি বলেই ফিরে আসা নিজের কাছে। আর কিছু নয়। আমাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন না হলে খুব ডিফিকাল্ট, পরিবর্তন আনা। নিষ্ঠার সাথে কাজটা করতে হবে। কাজ না করি, অন্তত দুর্নীতিটা করবো না। দুর্নীতি আমাদের মগজে ঢুকে গেছে। আমি এগুলো অভিযোগ করছি না। আমি যা বলছি, ওভারঅল। পুরো রাষ্ট্র কাঠামোটাকে আমার তাই মনে হয়েছে। এটাও মনে হলো এবার, ক্ষমতার কাছে গেলে সবার কেমন জানি চেহারা পাল্টে যায়। এটা দুঃখজনক। আমি আমার পুরনো চেহারাটা পাল্টাতে চাইনি। তাই ফিরে আসা।’

জাকিয়া বারী মম। ছবি: সংগৃহীত

এই ফিরে আসা প্রসঙ্গে অভিনেত্রী আরও জানান, ‘আমার যেহেতু ব্যক্তিগত কোনও চাওয়া পাওয়া নাই ক্ষমতার কাছে, শুধু কাজটাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। তাই ভাবলাম আমার ছেড়ে দেয়া পদে অন্য কেউ এসে অনেক কাজ করলে সেটা ভালো হবে কমিটির জন্য।’

এদিকে খোঁজ মিলেছে অনুদানের পূর্ণদৈর্ঘ্য কমিটি থেকে আরও অব্যাহতি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিস বিভাগের শিক্ষক ও অভিনেতা-নির্দেশক ড. আবুল বাশার মো. জিয়াউল হক (তিতাস জিয়া) এবং নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সম্পাদক সামির আহমেদ। তারাও পদত্যাগপত্রে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়েছেন।

‘পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি’র বাকি সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পদাধিকার বলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চলচ্চিত্র), তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক খান শারফুদ্দীন মোহাম্মদ আকরাম (আকরাম খান), চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার নার্গিস আখতার এবং রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি আহমেদ মুজতবা জামাল।

চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সম্পাদক সামির আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিস বিভাগের শিক্ষক ও অভিনেতা-নির্দেশক ড. আবুল বাশার মো. জিয়াউল হক (তিতাস জিয়া)। ছবি: সংগৃহীত

আর এই কমিটির সভাপতি হিসেবে আছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। শুরুতে যে পদে ছিলেন সাবেক উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।

এ বছর অনুদান প্রদানের জন্য মনোনীত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রবিনহুডের আশ্চর্য অভিযান’, ‘মায়ের ডাক’, ‘জুলাই’, ‘রূহের কাফেলা’, ‘পরোটার স্বাদ’, ‘খোঁয়ারি’, ‘জীবন অপেরা’, ‘জলযুদ্ধ’, ‘কবির মুখ’, ‘কফিনের ডানা’, ‘নওয়াব ফুজুন্নেসা’ এবং ‘জুঁই’।

অনুদানের জন্য মনোনীত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রসমূহ হলো ‘মন্দ-ভালো’, ‘ফেলানী’, ‘ঝুঁকির মাত্রা’, ‘জীবনের গান’, ‘হু হ্যাজ মেইড আস ফ্লাই’, ‘ভরা বাদর’, ‘১২৩০’, ‘বৃন্দারাণীর আঙুল’, ‘একটি সিনেমার জন্য’, ‘দাফন’, ‘সাঁতার’, ‘মাংস কম’, ‘গগন’, ‘অতিথি’, ‘বোবা’, ‘অদ্বৈত’, ‘আশার আলো’, ‘গর্জনপুরের বাঘা’, ‘হোয়ার দ্য ওয়াটার স্লিপস’ এবং ‘অপসময়’।

প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত শর্তসাপেক্ষে চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণের জন্য এই অনুদান প্রদান করা হবে।

ইত্তেফাক/এসএ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন