ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জমে উঠেছে ছাত্র রাজনীতির নানা সমীকরণ। নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক সভা করে চূড়ান্ত তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতিও নিয়েছে প্রশাসন। এর আগে আগস্ট মাসের প্রথমার্ধেই ডাকসুর ভোটগ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ হতে যাচ্ছে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানোর পর ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের প্যানেল গোছানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি সংগঠনই নিজেদের জনপ্রিয় এবং ক্যারিশমাটিক ছাত্রনেতাদের ভিপি (সহ-সভাপতি), জিএস (সাধারণ সম্পাদক) প্রার্থী করে প্যানেল গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে। বন্ধুপ্রতিম কিংবা কাছাকাছি আদর্শের ছাত্রসংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে শক্তিশালী যৌথ প্যানেল করার জন্যও নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কোনো ছাত্রসংগঠনে পদধারী না হয়েও ক্যাম্পাসের নানা আন্দোলন এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দেওয়া জনপ্রিয় শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে বিভিন্ন পদে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশেলে হবে ছাত্রদলের প্যানেল
ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সহযোগী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা শিক্ষার্থীবান্ধব নানা কাজ করে নিজেদের পরিচিতি বাড়াচ্ছেন। একইসঙ্গে সংগঠনটির শীর্ষনেতাসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে নিজেকে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন। ছাত্রদলের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা এবং বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের একাধিক ঘনিষ্ট সূত্র ইত্তেফাককে জানিয়েছে, ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ কারচুপি করে দখল করলেও সে নির্বাচনে ছাত্রদলের যেসব প্রার্থী শিক্ষার্থীদের মাঝে সাড়া জাগাতে পেরেছিলেন এবং ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে যেসব নেতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তাদের সমন্বয়ে শক্তিশালী প্যানেল গঠন করবে ছাত্রদল। ডাকসুর অধিকাংশ পদে জেতার প্রত্যাশায় তারুণ্য এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে প্যানেল গঠন করা হবে বলে আভাস দিয়েছেন ছাত্রদলের শীর্ষনেতারাও।
এক্ষেত্রে ২০১৯ সালের ডাকসুতে ছাত্রদলের প্যানেলে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শিক্ষার্থীদের মাঝে আলোচনায় আসা ঢাবি শাখা ছাত্রদলের প্রথম সহ-সভাপতি খন্দকার আনিসুর রহমান অনিককে এবার ভিপি পদে মনোনয়ন দেওয়ার আভাস পাওয়া গেছে। ভিপি পদে আরও আলোচনায় আছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি এইচ এম আবু জাফর, সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান এবং ঢাবি সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস। তবে একটা সূত্র জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদকসহ শীর্ষ পাঁচটি পদের নেতারা ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী না হয়ে নির্বাচন সমন্বয় এবং পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। ছাত্রদলের প্যানেলে জিএস পদে সংগঠনটির ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন আলোচনায় এগিয়ে আছেন। তবে আরেকটি সূত্রে জানা গেছে এই শীর্ষনেতাকে ভিপি পদে মনোনয়ন দিয়ে অপেক্ষাকৃত তারুণ্যনির্ভর প্যানেল দিতে পারে ছাত্রদল। সেক্ষেত্রে ২৪ এর অভ্যুত্থানে রাজপথে নেতৃত্বের ভূমিকায় থেকে পরিচিতি পাওয়া ঢাবি ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান এবং কবি জসিম উদ্দিন হলের প্রচার সম্পাদক শেখ তানভীর বারী হামীমকে জিএস বা এজিএস পদে মনোনয়ন দিয়ে চমক দেখাতে পারে ছাত্রদল। এছাড়াও জিএস এবং এজিএস পদে আরও আলোচনায় আছেন ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মানসুরা আলম, ঢাবি শাখার সিনিয়র সহসভাপতি মাসুম বিল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক নাছির উদ্দীন শাওন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক নূরে আলম ভূঁইয়া ইমন। ছাত্রদলের প্যানেলে অন্যান্য পদে আলোচনায় আছেন ঢাবি ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক আল আমিন, প্রচার সম্পাদক তানভীর হাসান, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক জুলফিকার জিসান হায়াত, শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান, মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক সৈয়দ ইমাম হাসান অনিক, আপ্যায়ণ বিষয়ক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক মেহেদী হাসান, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক রাকিবুল হাসান প্রমুখ।
ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি জানতে চাইলে ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সভাপতি গনেশ চন্দ্র রায় সাহস জানান, নির্বাচনের জন্য ছাত্রদল সব সময়ই প্রস্তুত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তপশীল ঘোষণা করলেই ছাত্রদল আনুষ্ঠানিক ভাবে প্যানেল ঘোষণা করবে।
নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই হবেন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের প্রার্থী
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়কদের একাংশ নিয়ে গড়ে উঠা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদও (বাগছাস) ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা জানিয়েছেন, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়েই তারা প্যানেল গঠন করবে। এক্ষেত্রে জুলাই আন্দোলনে ৯ দফার ঘোষক এবং বাগছাসের ঢাবি শাখার আহবায়ক আবদুল কাদের ভিপি পদে প্রার্থী হচ্ছেন। এ প্যানেল থেকে জিএস পদে প্রার্থী হবেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আহবায়ক এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম শীর্ষনেতা আবু বাকের মজুমদার। এছাড়া এজিএস পদে এ প্যানেল থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব জাহিদ আহসান, মুখপাত্র আশরেফা খাতুন, মুখ্য সংগঠক হাসিব আল ইসলাম এবং মুখপাত্র রাফিয়া রেহনুমা হৃদি। ডাকসু নির্বাচনে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পর্কে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আহবায়ক আবু বাকের মজুমদার ইত্তেফাককে জানান, বাগছাসের প্যানেল হবে ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেও ক্যাম্পাসে জনপ্রিয় এবং সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব করা শিক্ষার্থীরা তাদের প্যানেলে থাকবেন। এছাড়া জিতে আসার মতো স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরকেও নিজেদের প্যানেলে জায়গা দিয়ে পূর্ণ প্যানেলের জয় নিশ্চিত করতে চায় বলে জানিয়েছেন বাকের।
চমক দেখাতে চায় শিবির
শিবিরের নেতারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে কার্যক্রম না থাকলেও পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়ার মতো জনবল তাদের রয়েছে। ২৪ এর অভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক ও ঢাবি শিবিরের সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েমকে ভিপি প্রার্থী করে তারা প্যানেল গঠন করতে পারে বলে জানা গেছে। এছাড়াও ভিপি-জিএস পদে শিবিরের প্যানেলে আরও আলোচনায় আছেন কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ও ঢাবি শিবিরের সাবেক সভাপতি সিবগাতুল্লাহ, ঢাবি শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ এবং সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান। ডাকসুর প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ও ঢাবি শিবিরের সাবেক সভাপতি সিবগাতুল্লাহ ইত্তেফাককে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব করে ডাকসুতে এমন প্যানেল দেওয়ার জন্য কাজ করছে তারা। এক্ষেত্রে দলীয় প্যানেলে নারী, অমুসলিম এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে চমক দেখাতে চায় শিবির।
যৌথ প্যানেলে আগ্রহী বামপন্থী ও অন্যান্য সংগঠন
এদিকে ভোটের হিসেবে ক্যাম্পাসে অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত বামপন্থী সংগঠনগুলো, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের প্রতিষ্ঠিত ছাত্র অধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন এবং টিএসসিভিত্তিক সংগঠনগুলো একাধিক যৌথ প্যানেলে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট এবং বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীসহ সাতটি সংগঠনের জোট- গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট আলাদা প্যানেল দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সভাপতি আরমান হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এবং ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু এই প্যানেল থেকে শীর্ষপদে প্রার্থী হতে পারেন। স্বতন্ত্রভাবে ডাকসুতে ভিপি পদে প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক জামালুদ্দিন মোহাম্মদ খালিদ এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। এছাড়া জুলাই ঐক্য প্লাটফর্মের অন্যতম সংগঠক এবি জুবায়ের আলোচিত সাবেক শিবির নেতাদের নতুন প্ল্যাটফর্ম ‘আপ বাংলাদেশ’ থেকে ডাকসু নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন বলেও আভাস পাওয়া গেছে।